সংকটে অধিকাংশ নারীই যেখানে হাল ছেড়ে দেয়, আপোষকামিতায় মেনে নেয় নিজের ভাগ্য, সেখানে 'ফ্রিল্যান্সার নাদিয়া' নাটকের প্রোটাগনিস্ট বোঝায়- হাতের লড়াই পিঠ করতে পারেনা। দেয়ালে মুখ ঠেকলে তাই ঘুরে দাঁড়ানোই উচিত। মূলত, এ নাটকের মূলসূত্র এটি। আপ্তবাক্যও এটিই। এবং, সেজন্যেই এ নাটক দেখা উচিত সবার...

যদি আগে থেকেই জানা যায়, গল্প কেমন হবে, তাহলে সে গল্প পড়ার আগ্রহ কিংবা সে গল্পাশ্রয়ী নির্মাণ দেখার উৎসাহ অনেকটাই স্তিমিত হয়ে যায়। তবে, যদি এরকম হয়, যদিও জানেন আপনার গল্প পরিচিত, তবুও সে গল্পকে উপজীব্য করে বানানো নাটক থেকে চোখ সরাতে পারছেন না, তাহলে বুঝে নিতে হবে- নির্মাতা চমক রেখেছেন অন্যখানে। এবং সে চমকই হয়েছে আগ্রহের প্রভাবক। যেটা হয়েছে, 'বঙ্গ বব' দ্বিতীয় সিজনের তৃতীয় গল্প 'ফ্রিল্যান্সার নাদিয়া'র ক্ষেত্রে।

নাটকের টাইটেল থেকেই দুটি বিষয় পরিষ্কার। এক- গল্পটা এক নারীর। যার নাম নাদিয়া। দুই- তিনি ফ্রিল্যান্সার। অর্থাৎ, স্বাবলম্বী। এবং যেমনটা আমরা কল্পনা করতে পারি, 'নাদিয়া' নামের এ নারী হয়তো ব্যক্তিগত জীবনে প্রবল ঝড়জলের প্রকোপ সামলেও একসময়ে এসে প্রতিষ্ঠিত হবেন, নিজের পায়ে দাঁড়াবেন... মূল গল্পটাও ঠিক সেরকমই। সে গল্পের খানিকটা ইঙ্গিত দিয়েই বরং শুরু করি।

নাদিয়া মেধাবী একজন শিক্ষার্থী। এইচএসসি'তে 'গোল্ডেন এ প্লাস' পেয়েছেন। তার ইচ্ছে, পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন। নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। কিন্তু, এই ব-দ্বীপে গড়পড়তা মধ্যবিত্ত মেয়েদের স্বপ্ন কিংবা আকাঙ্খা বলে যে কিছু হয়না আসলে, সেটা তিনি জানতেন না। বাবার মৃত্যুর পরে সেটা তিনি জানলেন, যখন তাকে আচমকাই বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিলেন বড় ভাই। 'নাদিয়া'র গল্প ঠিক এই মুহুর্তে এসে হয়ে পড়লো এদেশের গড়পড়তা আরো দশজন নারীর গল্প। যে নারীরা পড়াশোনায় মেধাবী হওয়া সত্বেও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেনা, যাদের চোখভর্তি স্বপ্ন থাকলেও, সে স্বপ্ন মরে যায় অকালেই। পরিবারের চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্তের যূপকাষ্ঠে নিয়মিত বলি হতে হয় যে নারীদের, তাদেরই প্রতিনিধি হিসেবে  'নাদিয়া'র তখন শুরু হলো অন্য জীবন। 

এই জীবনেও সে যে খুব সুখী হতে পারলো, এমনও না। স্বামীর অল্প আয়ের টানাটানি সংসারের ক্লেশ, শ্বশুর-শাশুড়ি- ননদের নানা বায়নাক্কা আর হেঁশেলের ঝঞ্জাটে নাদিয়ার যাপিত স্বপ্ন ক্রমশই হয় ফিকে। তবে, এরইমধ্যে এক বৈপরীত্যও আসে জীবনে। খুব কাছের এক বান্ধবীর বরাতে নাদিয়া জানে ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে। গোপনে সে শুরুও করে ফ্রিল্যান্সিং কোর্স। এবং সে কোর্স শেষ করার পরে দুয়েকটি কাজও জুটে যায় তার। 

এরপরের গল্পটুকু আর বলছি না৷ সেটা দেখে নেয়াই হবে সমীচীন। তবে, গল্প যেমনই হোক, গল্পের যতটুকুই দর্শক আঁচ করতে পারুক না কেন, গল্পশেষের যে চমক, সেটা ধরতে পারা যে বেশ কষ্টেরই হবে, তা হলফ করে বলা যায়। খানিকটা অন্যরকম এক অনুভূতি দিয়েই শেষ হবে 'ফ্রিল্যান্সার নাদিয়া' নাটকের গল্প। 

ফ্রিল্যান্সার নাদিয়া

'ফ্রিল্যান্সার নাদিয়া' নাটকের এই যে 'নাদিয়া', সে নাদিয়ার সাথে গড়পড়তা নারীদের অনেকটুকু মিল আছে। ধ্রুবসত্যি। কিন্তু, পাশাপাশি একটা পার্থক্যও আছে। যে পার্থক্যই মূলত দিনশেষে গড়ে পার্থক্য। সেটি হচ্ছে- সিংহভাগ নারীই যেখানে হাল ছেড়ে দেয়, আপোষকামিতায় মেনে নেয় নিজের ভাগ্য, সেখানে এ নাটকের প্রোটাগনিস্ট বোঝায়- হাতের লড়াই পিঠ করতে পারেনা। দেয়ালে মুখ ঠেকলে তাই ঘুরে দাঁড়ানোই উচিত। মূলত, এ নাটকের মূলসূত্র এটি। আপ্তবাক্যও এটিই। 

এবার খানিকটা অন্য প্রসঙ্গে আসি। রাহিতুল ইসলামের গল্প 'চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার' অবলম্বনে ভিকি জাহেদের নাটক 'চরের মাস্টার' দেখেছিলাম গত ঈদে। রাহিতুল ইসলামের গল্পের একটা বিশেষ দিক, বেশ সাদামাটা গল্প বলেন তিনি। এবং সে গল্পের মধ্যে অনুপ্রেরণা, জীবনবোধ, প্রযুক্তির নানা লেয়ারও তিনি ব্লেন্ড করেন সে সাথে। ফলে, গল্পগুলো বেশ উপভোগ্য হয়। চিন্তারও খোরাক আসে ভেতরে। ঠিক সেরকমই, 'কেমন আছে ফ্রিল্যান্সার নাদিয়া' গল্প অবলম্বনে এই যে নাটক, যা বানালেন ইমরাউল রিফাত, তাতে সামাজিক বিধিনিষেধের রূঢ় বাস্তবতা যেমন রইলো, পাশাপাশি বজায় থাকলো অনুপ্রেরণার পেলব আখ্যানও। মেহজাবিন চৌধুরী, সুদীপ বিশ্বাস দ্বীপের অভিনয়ও হলো প্রাসঙ্গিক। আলাদাভাবে নজর কাড়লেন শামীমা নাজনীন। টিপিক্যাল শ্বাশুড়ি চরিত্রে 'কমপ্যাক্ট' পারফরম্যান্সই তিনি দিলেন। নাটকের এক অংশে ক্যামিও প্রেজেন্সে রইলেন গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। ইতিবাচক লাগলো সেটিও। 

শামীমা নাজনীনের অভিনয় বেশ মুগ্ধ করলো 

'বঙ্গ বব' অ্যান্থোলজি নিয়ে গতবছর বেশ প্রশংসা করেছিলাম। দ্বিতীয় সিজনে এসেও সে প্রশংসা কমছে না মোটেও। জানতাম, এ সিজনেও গল্পের বৈচিত্র‍্য থাকবে, এবং সে বৈচিত্র্য ইতোমধ্যেই বেশ ভালোভাবে টের পাওয়া যাচ্ছে। আশা করা যায়, সামনের গল্পগুলোও উপভোগ্য হবে। জীবনবোধের হবে। থট প্রভোকিং হবে। সেজন্যেই রইলো শুভকামনা। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা