'ভুল করলেও সেখান থেকে শিখতে চাই, নিতে চাই গঠনমূলক সমালোচনা'
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
খুব ভারী কিছু মাথায় নিতে চাই না। নিতে চাই মানুষের গঠনমূলক সমালোচনা। নিতে চাই নিজেকে আরো ডেভেলপড করার অনুষঙ্গ। নিজে ভুল করলেও সেখান থেকে শিখতে চাই। উপভোগ করতে চাই...
প্রথমদিকে যখন ক্যারিয়ার শুরু করেছি, আই ওয়াজ ভেরি মাচ এক্সপ্লোরিং ইট। পুরো জায়গাটা আমার কাছে নতুন ছিলো। ভীষণ কালারফুলও ছিলো। আমি যাদেরকে টিভি- সিনেমার স্ক্রিনে দেখে এসেছি বরাবর, তাদেরকে সামনাসামনি দেখতে পাচ্ছিলাম। অবাক হচ্ছিলাম। আমি ছোটবেলা থেকেই নিজেকে একজন অডিয়েন্স হিসেবে কল্পনা করেছি বরাবর। সেই আমি-ই 'অডিয়েন্স' থেকে শিফট হয়ে এরকম এক জায়গায় আসবো, একটা সিনেমা নিজে করবো, অথবা, এ পর্যন্ত জার্নিটা হবে, তা আমার দূরতম ভাবনাতেও আসেনি কোনোদিন।
যাই হোক, শুরুর সে বিস্ময়ের জায়গা ধীরে ধীরে অতিক্রম করেছি। প্রত্যেকটা স্টেপ পার হয়ে এসেছি। একজন 'আউটসাইডার' হিসেবে এসে আস্তে আস্তে অপরিচিত সবকিছুর সাথে অভ্যস্ত হয়েছি। সত্যি বলতে, আমার এই প্রফেশনটাকে মন থেকে ভালোবাসতে সময়ও লেগেছে। খুব কনফিউজড থাকতাম। এখনও যে থাকিনা, বিষয়টা এমন না। কোনটা করা উচিত, আর কোনটা ছাড়া উচিত- তা নিয়ে বিব্রত থাকতাম। অ্যাক্টিং খুব একটা পারতাম না। এখন খুব আহামরি পারি, সে দাবী করছি না৷ তবে শুরুর সময়ে অনেককিছুই সাধ্যের বাইরে ছিলো। এসব সাধ্যাতীত বিষয়গুলো নিয়ে জেদ করতাম। ভালো করার চেষ্টা করতাম। আপ্রাণ চেষ্টা করতাম।
এসবের মাঝখানেই খানিকটা ছন্দপতন হলো। বিদেশে গেলাম পড়াশোনা করতে। কয়েক বছর পরে, যখন আমি বিদেশ থেকে লেখাপড়া শেষ করে এসেছি, আমি এই প্রফেশনকে কেন যেন ভালোবাসতে শুরু করলাম। অভিনয় ভালো হচ্ছে না, বুঝতাম। আমি চেষ্টা করতাম। চরিত্রগুলোকে নিজের মত করে পোর্ট্রে করার চেষ্টা করতাম। আস্তে আস্তে সেটা কাজে এলো। অভিনয় মোটামুটি একটু পারলাম। এই ইন্ডাস্ট্রির ছোটখাটো বিষয়গুলো তখন লক্ষ্য করা শুরু করলাম। তখনই মনে হলো- দিস ইজ অ্যা বিউটিফুল প্লেস টু ওয়ার্ক।
যদিও, ততদিনে রিয়েল স্ট্রাগল শুরু হয়ে গিয়েছে। কারণ, এর আগে যখন কাজ করেছিলাম এ ইন্ডাস্ট্রিতে, তখন করেছিলাম, প্যাশনের জায়গা থেকে। পকেটমানির জন্যে৷ কিন্তু এখন যখন এলাম, এলাম এই ক্রাফটকে ভালোবেসে। এলাম, সবকিছুর বিনিময়ে। সে হিসেবে, এই সেকেন্ড ইনিংস শুরু করা খানিকটা টাফও হলো। আমাদের এমনিতেই গোল্ডফিশ মেমোরি। মানুষকে মনে রাখতেও সময় লাগেনা। ভুলে যেতেও সময় লাগেনা। তো, এই মানুষদের কাছে আমি কিভাবে যেতে পারবো, কিভাবে পৌঁছাতে পারবো, কিভাবে তাদের মনে থেকে যেতে পারবো- সেটা নিয়েই শুরু হলো স্ট্রাগল। অনেক কাজের অফার আসতে লাগলো। সাথে আসতে লাগলো কনফিউশনও৷ কারণ, কোন কাজটা নেবো, আর, কোনটা নেবো না, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। যেহেতু প্রত্যেকটা কাজের সাথেই কিছু না কিছু অর্থের বিষয় আছে, তাই কোনো কাজকে 'না' করার অর্থ, সেই কাজ-সংক্রান্ত পেমেন্টকে না করে দেয়া৷ এবং এই 'না' করার কাজটি যদি কন্টিনিউয়াস প্রসেসে হয়, অর্থাৎ, যদি নিয়মিতই কাজকে 'না' বলতে থাকি, তাহলে হয়তো একটা সময়ে আমাকে আর কেউ অ্যাপ্রোচই করবে না- এরকম ভয়ও ছিলো। এবং, এই ভয়ের জন্যেই আসলে প্রথমদিকে সাহসটা সেভাবে করে উঠতে পারিনি। যদিও পরে সে সাহস পেলাম। আর নিজেকেই নিজে বললাম- লেট ইট বি।
আমি দেখেছি, পৃথিবীতে কারো নেম-ফেম সারাজীবন থাকেনা৷ আমি এটাও দেখেছি, জনপ্রিয় অনেক মানুষই শেষে এসে হতাশাগ্রস্ত হয়ে যান। কারণ, এই জায়গাটা একটু কঠিন৷ ডিফারেন্ট৷ সিনেমার এ জগৎটা স্বপ্নের জগৎ তো, তাই স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলে কষ্টটাও হয় বেশ গভীর। আমি সেভাবেই তাই নিজেকে প্রস্তুত করেছি। খুব বেশি চাহিদা না। যেটুকু না থাকলেই না, সেটুকুই শুধু চেয়েছি। হাই এক্সপেকটেশন, ওভার অ্যাম্বিশন... এসবের কোনোকিছুই রাখিনি। এটাই গোল, এখানে পৌঁছাতেই হবে... এসবের কোনোকিছুই মাথায় আনিনি। মাথায় রাখিনি। মূলত, এই বিষয়টাই আমাকে হেল্প করেছে শেষমেশ। পরবর্তীতে যখন সিনেমায় হ্যাঁ/না বলেছি, সাহসী হতে পেরেছি। সাহস করে অনেক 'লুক্রেটিভ' অফারও ছেড়েছি। এমন সব প্রজেক্টে কাজ করেছি, যেটা করতে সাহসের দরকার। সেসব কাজ করেছি। এবং সেসব কাজ আমাকে পুরস্কারও দিয়েছে।
এমন না যে, এই প্রসেসে ভুল করিনি। করেছি। সব প্রসেসেই কিছু না কিছু ভুল হয়। অনেক কিছু আরো ভালো হয়তো করতে পারতাম। সেসবও ভেবেছি। এবং, এসব করতে করতেই ক্রমশ এই জার্নিটাকে ভালোবেসে ফেলেছি। এ প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি। অনেকেই হয়তো খেয়াল করে থাকবেন, আমার একটা শখের গাড়ি আছে। এই গাড়িটা আমি বেশ আহ্লাদ করেই কিনেছি। এবং আমার 'এক্সপেনসিভ বাই' এর মধ্যে এটাই আছে শুধু। এই গাড়ি কেনার পেছনের ইতিহাসটা যদি বলি- ছোটবেলায় যখন গাড়ি নিয়ে খেলতাম, তখন থেকেই একটা ইচ্ছে ছিলো- আমার একদিন ছাদখোলা একটা গাড়ি থাকবে। আমি যখন গাড়িটা চালাবো, তখন আমার মুখে, গায়ে বাতাস লাগবে। আর আমি একটা সুন্দর রাস্তা দিয়ে ড্রাইভ করে যাবো৷ এতটুকুই ছিলো স্বপ্ন। ঐ গাড়ি নিয়ে আমি কই যাবো, কতদূর যাবো... এর কিছুই আমার ভাবনায় তখন আসেনি৷ মূলত, এভাবেই, এই গাড়ি নিয়ে সুন্দর একটা রাস্তায় ড্রাইভ করার মত করেই আমি এ প্রফেশনকে নেয়ার ট্রাই করেছি৷
প্রত্যেকটা মোমেন্ট, প্রত্যেকটা মেমোরিজ, যারা ভালো বলেছেন, তাদের প্রত্যেকটা কমেন্ট, প্রত্যেকটা রিভিউ মাথায় নেয়ার চেষ্টা করেছি৷ কিছু মানুষের মন্তব্যে কষ্ট পেয়েছি। সোশ্যাল মিডিয়ার এ যুগে যারাই যখন যেভাবে পার্সোনাল লাইফ নিয়ে নোংরা কথা বলেছে, পরিবার নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছে, তা দেখেছি, হতাশ হয়েছি। জানি, এরা অনেকেই ফেইক প্রোফাইল, এদের কথা হয়তো সেরকম ভ্যালুও অ্যাড করেনা লাইফে, তবুও খারাপ লাগবেই। বিশেষ করে আপনি যখন ভালোবেসে এরকম একটা প্রফেশনে আসবেন, তখন মানুষের এরকম বাজে মন্তব্য খানিকটা হলেও প্রতিবন্ধকতা তৈরী করবে। সেটা আমার ক্ষেত্রেও হয়েছে। অনেকটা স্পিড ব্রেকারের মতন হয়েছে। তবে স্পিড ব্রেকার মানে এই না যে, গাড়িটা থেমে যাচ্ছে পুরোপুরি। আমি হয়তো একটু থমকে যাচ্ছি। কিন্তু আটকে তো যাচ্ছি না৷ এভাবেই বিষয়গুলোকে ট্যাকেল দিয়েছি। ভেবেছি- এই মানুষেরা আর কয়দিনই বা এরকম খারাপ কথা বলবে? একসময় এসে তো তারা থামবেই। অথবা, যদি আমারই মনে হয়, আমি আর নতুন কিছু দিতে পারছিনা, আমিই স্বেচ্ছায় বিদেয় নিয়ে নেবো। তবে, সে সময় যেহেতু এখনো আসেনি, যেহেতু এখনও মোমেন্টাম পাচ্ছি, গাড়ি ড্রাইভ করতে ভালো লাগছে, আমি তাই এই মোমেন্টটা এঞ্জয় করছি। থামছি না।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, অনেকেই দূর থেকে মনে করে, কন্টেন্ট ইন্ডাস্ট্রির এই লাইফটা অনেক বেশি লুক্রেটিভ, অনেক বেশি লাইটস, ক্যামেরা, অ্যাকশন, ফ্ল্যাশ। কিন্তু সত্যি বলতে, তারা পুরো প্রসেসটা জানেনা। ভেতরের প্রসেসটা খুবই কমপ্লিকেটেড এখানে৷ আমি যখন প্রথম প্রথম এই কমপ্লিকেটেড জায়গাটাতে আসি, আমার কাছে অপশন ছিলো দুইটা- দেখে দেখে শেখা, অথবা, ঠেকে ঠেকে শেখা। তো আমি দুইভাবেই শেখার চেষ্টা করেছি। এখনো করে যাচ্ছি৷ এবং সবরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হবার জন্যেই নিজেকে তৈরী করেছি। করে যাচ্ছি। কারণ, প্রত্যেকটা দিন আমাদের ভালো যায়না৷ দিন ভালো আসে৷ খারাপ আসে। জঘন্যও আসে৷ সে কারণেই তাই সব পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে কাজ করি। সেসব মানুষদের জন্যে কাজ করি, যারা প্রতিনিয়ত অনুপ্রেরণা দিয়ে যান, ভালোবেসে যান। যে তালিকায় বৃদ্ধ থেকে শুরু করে ছোট বাচ্চাদেরও পাই৷ ভাবতে ভালো লাগে, বাংলাদেশের কন্টেন্ট ইন্ডাস্ট্রির সাথে যুক্ত হয়ে এভাবে আমি মানুষের সুখে-দুঃখে থাকতে পেরেছি। এক জেনারেশন থেকে আরেক জেনারেশনকে স্পর্শ করতে পেরেছি৷ আমার মনে হয়, এভাবেই হয়তো আমি আরো বেশি কিছুদিন মানুষের মাঝে বেঁচে থাকার সুযোগ পাচ্ছি।
যাই হোক, অনেক ভারী কথা বললাম, যেসব কথা আমার সাথে একেবারেই বেমানান। কারণ, আমি মানুষ হিসেবে খুবই লাইট-হার্টেড মানুষ। সারাক্ষণই বলতে গেলে ফান মুডে থাকি আমি। কাজের সময়টুকু বাদে। সে সময়ে আমি দায়িত্ব নিয়ে কাজ করি। আনন্দ নিয়ে কাজ করি। এবং যতদিন আছি, এরকম আনন্দ নিয়েই কাজ করতে চাই। দেয়ার ইজ নো রাশ টু বি সামওয়ান। কারণ, যত কিছুই করিনা, যত কিছুই হতে চাইনা কেন, দিনশেষে মৃত্যুই অন্তিম নিয়তি। এবং এটাই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। তাই সেটুকু মাথায় রেখেই ঠিকঠাক করে যেতে চাই সব। খুব ভারী কিছু মাথায় নিতে চাই না। নিতে চাই মানুষের গঠনমূলক সমালোচনা। নিতে চাই নিজেকে আরো ডেভেলপড করার অনুষঙ্গ। নিজে ভুল করলেও সেখান থেকে শিখতে চাই। উপভোগ করতে চাই৷ কারণ, অ্যাট দ্য এন্ড অফ দ্য ডে, লাইফ ইজ আ বিউটিফুল জার্নি। অ্যান্ড, উই মাস্ট এঞ্জয় ইট!