এই মুহুর্তে: সোশ্যাল প্যারাডক্সের দুর্দান্ত উপস্থাপন!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
এই অ্যান্থোলজি ফিল্মে সেন্সেটিভ অনেক ইস্যু নিয়ে ডিল করা হয়েছে। কিন্তু কোনোকিছুই অতিরঞ্জিত করা হয়নি। স্পর্শ করা হয়েছে অনেককিছুকেই। কিন্তু, চাপিয়ে দেয়া হয়নি কিছুই। বোঝানো হয়েছে অনেক বিষয়ই। কিন্তু, পরিমিতিবোধকে ছাপিয়ে যায়নি তা। মূলত, সেসব কারণেই, 'এই মুহুর্তে' রেকোমেন্ডেড।
যদিও আমাদের জীবনের গণ্ডি সীমাবদ্ধ, তবুও আমরা এই সীমাবদ্ধ গণ্ডির খড়িমাটিতে থেকেই দেখতে চাই বহু জীবন। পেতে চাই এক চরিত্রে বহু চরিত্রের মিশেল। অন্যের জীবনে লুকিয়ে-চুরিয়ে যেমন ঢুকতে চাই, তেমনি হাত-ছোঁয়া দূরত্বে থেকে দেখতে চাই নিজের জীবনকেও। মূলত, সেজন্যেই আমরা আশ্রয় খুঁজি বইয়ে, সিনেমায়, গানে... যাপিত নির্মাণে। আর, যদি 'আশ্রয়' হিসেবে আঁকড়ে ধরা সে মাধ্যম জম্পেশ হয়, গভীর জীবনবোধের সন্ধান দেয়, তাহলে খানিকটা হলেও জীবনকে ছেনেকুটে দেখার যে তৃপ্তি হয়, সে তৃপ্তিও হয় বেশ অপার্থিব।
যেমনটা হয়- চরকি'র নতুন অমনিবাস 'এই মুহুর্তে' দেখে। প্রিয় লেখক আহমদ ছফা যেমন বলেছিলেন- প্রত্যেক লেখকেরই দায় থাকে, নিজের সময়কে নিজের কলমে তুলে ধরার। খানিকটা সেরকমই দেখি 'এই মুহুর্তে' অমনিবাসে। আমাদের আশপাশ মুহুর্তেই মুহুর্মুহু যেভাবে পাল্টায়, রাতারাতি যেভাবে পাল্টায় দৃশ্যপট, সুনামগঞ্জ, ফেমিনিজম কিংবা পদ্মা সেতু... চায়ের টেবিলে যেভাবে চলে ফরাসি ডুয়েল... এসব নিয়ে কেন কেউ কিছু বানাচ্ছে না, সে আক্ষেপ ছিলো বহুদিন ধরেই। এবং, যে আক্ষেপের অনেকটুকুই কমেছে 'এই মুহুর্তে'র ন্যারেশনে। 'এই মুহুর্তে'র গল্পে। তিনটি ভিন্ন গল্প, তিনটি ভিন্ন জঁরা, তিনজন ভিন্ন পরিচালক... অথচ গল্পগুলোর মধ্যে আশ্চর্য গভীর মিল। তবে, সে মিলের প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। আগে বরং গল্পগুলোর বুনোট নিয়েই কথা বলি।
প্রথম গল্প- কোথায় পালাবে বলো, রূপবান? দিয়েই শুরু হোক। গল্পের টাইটেল পড়েই যদি ধরে নিয়ে থাকেন, লোকসংস্কৃতির যে 'রূপবান'কে আমরা চিনি, সেই রূপবানকে নিয়েই এখানের গল্প, তাহলে খানিকটা ভুল ভাবছেন। এই যে রূপবান, তিনি এ সময়ের। তার সংকটটাও আধুনিক। কিন্তু ললাটের লিখন? সেটা যেন আগের সেই প্রাচীন সময়েরই জেরক্স। কিভাবে? এই মান্ধাতার ললাটের সাথে আবার চিড়িয়াখানা থেকে পালিয়ে আসা বাঘেরই বা কি সম্পর্ক, মনের বাঘ বড় নাকি বনের (এখানে- খাঁচার) বাঘ বড়... এসব প্রশ্নেরও মুখোমুখি করে এ গল্প। এভাবেই এগোতে এগোতে যখন শেষ হয়, তখন খানিকটা ধন্দ লাগে। মেজবাউর রহমান সুমন স্পুনফিডিং না করেই করেন যবনিকাপাত। দর্শকের ঘাড়ে খানিকটা টোকা দিয়েই যেন বলেন- বোঝা গেলো ব্যাপারটা?
দ্বিতীয় গল্প- ওয়ান পিস মেড, কারিগর ইজ ডেড৷ আবরার আতহারের স্যাটায়ার, ডার্ক কমেডি। বাংলাদেশে 'ডার্ক কমেডি' জঁরায় কাজ করা যে অনেকটা আগুন নিয়ে খেলার মতই ভয়ঙ্কর বিষয়, তা সবারই মোটামুটি জানা। এই 'চরকি'তেই ডার্ক কমেডি 'ইউটিউমার' আসার পরে ব্যাকল্যাশ কম হয়নি। এর পেছনে কারণও আছে। কারণ হচ্ছে- এদেশীয় অডিয়েন্সকে কোয়ালিটি কন্টেন্ট দিয়ে হাসানো শক্ত। ডার্ক কমেডি দিয়ে হাসানো আরো শক্ত। তবুও, এসব জানা সত্বেও, নির্মাতা আবরার আতহার সাহস করলেন। একজন জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পীর আচমকা আটক আর সে আটককে কেন্দ্র করে পুরো শহরটাই ট্রাপিজের সরু তার হয়ে যাওয়া... স্থুল এবং সূক্ষ্ম দুইভাবেই নির্মাতা দেখালেন যাপিত অসঙ্গতিকে। সোশ্যাল স্ট্যাটাস, লোকাল নিউজপেপার, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কিংবা সুপারফিশিয়াল ভাইরাল ভিডিও... এলো সবই। সিনেমার ন্যারেশন স্টাইলেও থাকলো চমক। থাকলো সারকাজমের পাশাপাশি কটাক্ষও।
তৃতীয় গল্প- কল্পনা। 'এই মুহুর্তে' অ্যান্থোলজির সবচেয়ে স্লো-পেসড গল্প। স্লো-বার্ণ বলাই উচিত। যে গল্পে বর্ষণস্নাত ফুটপাতে দুই নর-নারীর শারীরিক উষ্ণতা চলে এলো অজ্ঞাতনামা ক্যামেরাম্যানের ক্যামেরায়। সেখান থেকে সোশ্যাল মিডিয়া। শুরু হলো মিডিয়া ট্রায়াল। কমেন্টের বীরদর্প। তর্জনগর্জন। তিল থেকে তাল। এরইমধ্যে ইতালি থেকে আসা এক ভদ্রলোক কিনলেন এক কেজি শিং মাছ। বাসায় ফিরে রান্না করলেন শিং-মাছের দোপেয়াজা। এই দুই ঘটনার সম্পর্ক কোথায়? কেনই বা লিখলাম? প্রশ্ন উঠছে মনে? উঠুক। 'এই মুহুর্তে' দেখেই সে প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন নির্ঘাত। সবচেয়ে ভালো লাগলো- বহু দিন পরে সারা যাকের ও জাহিদ হাসানকে দেখে। সম্ভবত তারা প্রথমবারের মতই এলেন ওটিটি'তে! পিপলু আর খান গল্পটাকে বুনলেও ধীরে ধীরে। তাড়িয়ে তাড়িয়ে।
এবার আসি, এই তিন গল্পের মিলের জায়গায়। গল্পের সিনোপসিস পড়ে এটুকুতে প্রায় সবাই একমত হবেন, এক গল্পের সাথে আরেক গল্পের আপাত দৃষ্টিতে মিল নেই। তবে, আক্ষরিক দৃষ্টিতে মিল না থাকলেও ভাবগত মিল প্রচুর। প্রথমত- তিনটি গল্পই সমাজের অসঙ্গতিকে নির্দেশ করে। দ্বিতীয়ত- তিন গল্পেই টানাপোড়েনের ভরকেন্দ্রে থাকেন নারী। প্রথম গল্পের সদ্য 'মা' হওয়া সেই নারী, দ্বিতীয় গল্পের নারী সেলিব্রেটি এবং তৃতীয় গল্পের সেই নারী ভিক্টিম... এই তিন নারীকে কেন্দ্র করেই গল্পের জট খোলে, আবার, জট পাকায়ও। তৃতীয়ত, তিনটি গল্পের কোনোটিই 'নটে গাছটি মুরোলো'জাতীয় স্বস্তি দেয়না। প্রতিটি গল্পকেই নানাভাবে বিশ্লেষণের জায়গা থাকে। 'ফুড ফর থট' এর সুযোগ থাকে। লাস্ট বাট নট লিস্ট, প্রত্যেকটা গল্পে সোশ্যাল কনটেক্সট এর কমপ্লেক্সিটাও খুব ভালোভাবে রিলেট করা যায়৷ সে কমপ্লেক্সিটিকে কানেক্ট করা যায় নিজের সাথেও।
এসব কারণ মিলিয়ে, তাই এটুকু বলাই যায়, 'এই মুহুর্তে' খুবই কেয়ারফুলি ক্রাফটেড একটা কন্টেন্ট। এখানে সেন্সেটিভ অনেক ইস্যু নিয়ে ডিল করা হয়েছে। কিন্তু কোনোকিছুই অতিরঞ্জিত করা হয়নি। স্পর্শ করা হয়েছে অনেককিছুকেই। কিন্তু, চাপিয়ে দেয়া হয়নি কিছুই। বোঝানো হয়েছে অনেক বিষয়ই। কিন্তু, পরিমিতিবোধকে ছাপিয়ে যায়নি তা। মূলত, সেসব কারণেই, 'এই মুহুর্তে' রেকোমেন্ডেড। এই মুহুর্তে, এই সমাজে যারা এভাবেই বেঁচে আছেন, জীবনযাপন করছেন... তাদের প্রত্যেকের জন্যে রেকোমেন্ডেড।