সাতাশ মিনিটের এই নির্মাণে ভালোবাসা, ব্যর্থতা, রহস্য, থ্রিলার, ক্রাইম... এতগুলো লেয়ার কে আলাদা দ্যোতনায় একসুতোয় গাঁথার যে দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা দেখিয়েছেন নির্মাতাসহ পুরো টিম, তাতে তারা যে সফল, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা...

বিখ্যাত রম্য লেখক মার্ক টোয়েইন দিয়েছিলেন এক অমোঘ বাণী- Truth is stranger than fiction. কলমের খোঁচায় গল্পের গরুকে গাছে ওঠানো সম্ভব, কিন্তু বিস্ময়বোধ হয় তখন, যখন বাস্তব টেক্কা দেয় আকাশকুসুম কল্পনা কে। তখন অল্পবিস্তর ধন্দ লাগে। আবার, এমনটা যদি হয়, কোনো এক ম্যাড়মেড়ে সন্ধ্যায় লেখকের গ্রে ম্যাটার থেকে বের হওয়া শব্দেরা মিলেমিশে বাস্তব হয়ে ওঠে, গল্পের চরিত্র মুখোমুখি দাঁডায় লেখকের, সৃষ্টির সমুখে স্রষ্টা...তখন যে অপার্থিব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, সেটারও বা মোকাবেলা হয় কিভাবে? 

আমির হোসেন নামের এক ভাগ্যাহত তরুণ জীবিকার সন্ধানে পাড়ি জমায় ইট-কাঠ-পাথরের ঢাকায়। পেছনে ফেলে রেখে আসে নিজের গ্রাম, নিজের বাবা-মা, নিজের প্রেমিকা, বন্ধু-শত্রু সবাইকে৷ ঢাকায় এসে কাজ নেয় এক ফটোকপির দোকানে৷ সারাদিন দোকানে খাটুনি আর রাতে তেল চিটচিটে বালিশ আর বিবর্ণ-মলিন চাদরে বিগত অতীত কে পাশবালিশ বানিয়ে ঘুম... আমির মানিয়ে নেয় এই নতুন জীবনেও। 

আমির হোসেন মানিয়ে নেয় এই নতুন জীবনেও! 

কিন্তু মানিয়ে নেয়ার এই রকমফের চিরস্থায়ী হয় না৷ ফটোকপির দোকানে একদিন আসে পুরোনো এক ম্যাগাজিন৷ যে ম্যাগাজিনের এক গল্পে চোখ আটকে যায় আমিরের৷ হুবহু তার জীবন-গল্পই যেন লিখে রেখেছে এক লেখক৷ আমির শুরু করে এই লেখককে খোঁজার কাজ। পেয়েও যায় লেখককে সে একদিন৷ এরপরই শুরু হয় অদ্ভুতুড়ে একেক ঘটনা। 

ডক্টর ফরহাদ; পেশায় ডাক্তার, নেশায় লেখক! 

'ডোন্ট রাইট মি' গল্পের প্রাথমিক প্রেরণার সাথে সৃজিত মূখার্জীর সিনেমা 'চতুষ্কোণ' এর একটি গল্প, সন্দীপ রায়ের 'চার' সিনেমার এক গল্প, রাজশেখর বসু, অ্যাডগার অ্যালেন পো'র গল্পের খানিকটা মিল খুঁজে পাওয়া কাকতালীয় না। তবে এটুকুই মিল। বাদবাকি ঘটনা আনকোরা নতুন। সে সাথে গল্পের শেষে থাকে এক অপ্রত্যাশিত চমকও। যে চমক এতটাই অর্থবহ, গল্পের আবহই পাল্টে দেয় পুরোপুরি। 

বর্ষীয়ান গুণী অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর কে অনেকদিন পরে দেখলাম কোনো নির্মাণে। 'লেখক ফরহাদ' চরিত্রটির মধ্যে কিছুটা পাগলামি, কিছুটা রসবোধ, কিছুটা অদ্ভুতুড়ে আচরণের মিশেল প্রত্যক্ষ করবে যে কেউ। বলিষ্ঠ অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর এই মিশেল খুব দারুণভাবে তুলেও আনলেন পর্দায়। 'আমির' চরিত্রে সোহেল মণ্ডল এর অভিনয় নিয়েও প্রশংসা করা ছাড়া কিছু বলার নেই। ওয়েব সিরিজ 'তাকদীর' তাকে যে পাদপ্রদীপের তলে নিয়ে এসেছে, সেখান থেকে এই পর্যন্ত তার যাত্রাপথে সে নিরাশ করেনি মোটেও। যেখানেই যেসব চরিত্রে তাকে দেখেছি, তা ছোট হোক অথবা বড়, তিনি চরিত্রের সাথে মিশে গিয়েছেন। এই নির্মাণে তাই আসাদুজ্জামান নূর এবং সোহেল মণ্ডলের দ্বৈত অভিনয়শৈলীতে মুগ্ধ হয়েছি। বাকিরা খুব বেশি রানটাইম পান নি। তবে খাপছাড়া অভিনয় কারোরই নেই। 

ক্যামেরার ছিমছাম কাজ বেশ প্রশংসনীয় ছিলো! 

ঊনলৌকিক সিরিজের প্রথম নির্মাণ 'মরিবার হলো তার স্বাদ' থেকেই নির্মাণশৈলীর যে অভিনবত্বের আঁচ পাওয়া যাচ্ছিলো, সেটা বজায় ছিলো এই নির্মাণেও। নির্মাতা রবিউল আলম রবি'র ক্যামেরার কাজ, ন্যারেশন স্টাইল অথবা ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের পরিচ্ছন্ন ব্যবহার...ভালো লেগেছে। গুণী অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর'কে ট্রিবিউট দেয়ার জন্যে যেভাবে কালজয়ী নির্মাণ 'কোথাও কেউ নেই' এবং 'আজ রবিবার' এর মেমোয়ার কে ব্যবহার করা হয়েছে এই ড্রামায়, তা আলাদা করে প্রশংসার যোগ্য। সাতাশ মিনিটের এ নির্মাণে ভালোবাসা, ব্যর্থতা, রহস্য, থ্রিলার, ক্রাইম...এতগুলো লেয়ার কে আলাদা দ্যোতনায় একসুতোয় গাঁথার যে দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা দেখিয়েছেন নির্মাতাসহ পুরো টিম, তাতে তারা যে সফল, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। 

চরকি'র 'ঊনলৌকিক' অ্যান্থোলজি সিরিজ এখন পর্যন্ত যে গতিতে এগোচ্ছে, শেষপর্যন্ত এ গতি বজায় রাখলে, সাইকোলজিক্যাল ড্রামা জনরার এক আলাদা বেঞ্চমার্কে এই নির্মাণ নিজেকে নিয়ে যাবে বলেই প্রতীয়মান হয়। 

শুভকামনা রইলো পরবর্তী পর্বগুলোর জন্যে৷ 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা