ভাষা আন্দোলন ও একুশে ফেব্রুয়ারী ঠাঁই পেয়েছে যে সিনেমাগুলোতে
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
বাঙালীর সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অর্জনের একটি হচ্ছে ভাষা আন্দোলন, অথচ বায়ান্নর সেই একুশে ফেব্রুয়ারী সেলুলয়েডে ঠাঁই পেয়েছে খুব কম! গত ৬৯ বছরে মাত্র ৩টি সিনেমা নির্মিত হয়েছে ভাষা আন্দোলন নিয়ে!
জাতি হিসেবে বাংলাদেশীদের জন্য গর্বের অর্জন যা কিছু আছে, তার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ এবং ভাষা আন্দলন সবার ওপরেই থাকবে। পৃথিবীর বুকে একমাত্র বাঙালীই তার মাতৃভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল রাজপতে, রক্ষা করেছিল ভাষার সম্মান। অথচ গৌরবোজ্জ্বল সেই অধ্যায় সেলুলয়েডে ঠাঁই পেয়েছে খুব কম। বাংলা সিনেমায় ভাষা আন্দোলন বড় পরিসরে উঠে এসেছে মাত্র তিনবার। জহির রায়হানের 'জীবন থেকে নেয়া', শহীদুল ইসলাম খোকনের 'বাঙলা' এবং বছর দুয়েক আগে মুক্তি পাওয়া তৌকীর আহমেদের 'ফাগুন হাওয়ায়'- এই হচ্ছে ভাষা আন্দোলন নিয়ে নির্মিত বাংলা সিনেমার খতিয়ান।
বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারী এখন ৬৯ বছর আগের সাদাকালো এক স্মৃতি, দেশ স্বাধীনেরও পঞ্চাশ বছর পার করে ফেলেছি আমরা। অথচ মায়ের ভাষার দাবীতে যে সূর্যসন্তানেরা রক্ত দিয়েছিল, শহীদ হয়েছিল, তাদের গল্পটা পরবর্তী প্রজন্মকে সিনেমার মাধ্যমে শোনানোর তাগিদ ছিল না নির্মাতাদের মধ্যে। হয়তো এধরণের সিনেমায় দর্শকের আগ্রহ নেই, আবেদন নেই, গ্ল্যামার নেই, লগ্নিকৃত অর্থ ফিরে আসার গ্যারান্টিও নেই; কিন্ত এতসব মাথায় রেখেও, ৫০ বছরে এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের দেশটাতে ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে মাত্র তিনটা সিনেমা বানানো হয়েছে- এই পরিসংখ্যানটাই যথেষ্ট হতাশাজনক।
জীবন থেকে নেয়া
জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া শুধু সিনেমা নয়, এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের শোষণের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার হাতিয়ার। যেভাবে মেটাফোরের মাধ্যমে জহির রায়হান তিক্ত বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, সেটা এক কথায় অনবদ্য।
‘পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চলচ্চিত্র’ এই অভিযোগে সিনেমাটির শুটিং চলাকাকেই জহির রায়হানকে ক্যান্টনমেন্টে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু পরে উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী। ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে জহির রায়হান একুশে ফেব্রুয়ারী নামের একটা সিনেমা বানাতে চেয়েছিলেন ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে। কিন্ত সেটারও অনুমতি পাওয়া যায়নি।
বাঙলা
আহমদ ছফার 'ওঙ্কার' উপন্যাস অবলম্বনে শহীদুল ইসলাম খোকন নির্মাণ করেছিলেন 'বাঙলা' নামের সিনেমাটা। এই চলচ্চিত্রের মূল চরিত্র একজন বোবা স্ত্রী। জগতের সবকিছু থেকে নির্লিপ্ত হয়ে যাওয়া সেই নারীকে ভাষার মিছিলই করে তোলে চঞ্চল, কৌতূহলী।
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান সেই নারীকে স্পষ্টভাবে প্রথমবারের মতো ‘বাংলা’ শব্দটি উচ্চারণ করায়। তখন তার মুখ দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে আসে রক্ত, সে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিত। সেই রক্ত শহীদ আসাদের নাকি সেই বোবা মহিলাটির- এই প্রশ্ন ধাক্কা দিয়ে যায় দর্শককে।
ফাগুন হাওয়ায়
ভাষা আন্দোলনের প্রায় সাত দশক পরে এসে তৌকীর আহমেদ নির্মাণ করেছিলেন ফাগুন হাওয়ায়, গল্পের বিষয়বস্তু সেই একুশের ঘটনাবলী। তবে ছবিতে শুধু ভাষা আন্দোলনের দিন পর্যন্ত তথা ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গ্রাম্য পটভূমিতে ঘটে যাওয়া ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। এরই পাশাপাশি ছিল একটা নাট্যদলের গল্প, ছিল প্রেম, ছিল প্রতিবাদ, ছিল বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ।
পুলিশ ইন্সপেক্টর জামশেদের ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন ভারতীয় অভিনেতা যশপাল শর্মা। ফাগুন হাওয়ায় কিছুক্ষণের জন্য আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বায়ান্নোর অগ্নিঝরা দিনগুলোতে, স্মরণ করিয়ে দিয়েছে বাঙালীর মাথা নত না করার জেদের কথা।
পরিশিষ্ট: আমাদের সরকার এবং নির্মাতাদের বোধহয় এই জায়গাটায় আরেকটু মনোযোগ দেয়া উচিত, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গল্পগুলোকে খুঁজে আনা উচিত অতীতের গলিঘুঁপচি থেকে খুঁজে। নইলে পরের প্রজন্মকে শোনানোর মতো ইতিহাস রইবে না খুব বেশি...