চন্দ্রাবতী কথা: যে সিনেমাটি নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে আমাদের দেশে সিনেমা নির্মান হয় না বললেই চলে। বাজেট ঘাটতি, দর্শকের অনাগ্রহ, আধুনিক প্রযুক্তি ও মানসম্মত প্রেক্ষাগৃহের অভাব- কারণ অনেক। সেখানেই বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারীবাদী কবি চন্দ্রাবতীর লেখক হয়ে ওঠার বেদনাবিধুর কাহিনী অবলম্বনে বানানো হয়েছে সিনেমা...
ইতিহাস, ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি অথবা ঐতিহাসিক অনেক ব্যাক্তি বা চরিত্র অবলম্বনে পৃথিবীর নানা দেশেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নান্দনিক সিনেমা নির্মিত হয়েছে। এসব সিনেমা সারাবিশ্বের সিনেমাপ্রেমী দর্শকদের বিনোদনের খোরাক যুগিয়েছে। আমেরিকা, ইউরোপ, চীন, কোরিয়ার নির্মাতারা এরকম সিনেমা নির্মানে চমক দেখাচ্ছে অনেক দিন ধরেই। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে ঐতিহাসিক নানা চরিত্র এবং ঘটনা সেলুলয়েডে তুলে ধরছেন মুন্সিয়ানার সাহায্যে।
আমাদের দেশে এধরনের সিনেমা নির্মান হয় না বললেই চলে। সিনেমা হল কমে যাওয়া, সিনেমার বাজেটের কমতি, দর্শকদের হল বিমুখতা, আধুনিক প্রযুক্তির নানা সুবিধার অপ্রাপ্তি সহ নানা কারনে এই ধরনের বিশাল ক্যানভাসের সিনেমা নির্মান করতে প্রযোজক বা পরিচালকেরা সেভাবে এগিয়ে আসেন না। তবে সম্প্রতি একটি এই ঘরানার সিনেমা সেন্সর সার্টিফিকেট লাভ করেছে। সিনেমার নাম ‘চন্দ্রাবতী কথা’। সত্য ঘটনা অবলম্বনে এরকম একটি ঐতিহাসিক সিনেমা নির্মান করেছেন নির্মাতা এন রাশেদ চৌধুরী।
২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রাপ্ত সরকারি অনুদান এবং ম্যানগ্রোভ পিকচারস ও বেঙ্গল ক্রিয়েসন্স-এর যৌথ প্রযোজনায় সিনেমাটির কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। সিনেমাটির কাহিনী নিয়ে গবেষণা, প্রাক-প্রযোজনা, চিত্রগ্রহণ ও সম্পদনাসহ সম্পূর্ণ নির্মাণে পাঁচ বছর সময় লেগেছে। বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারীবাদী কবি চন্দ্রাবতীর লেখক হয়ে ওঠার বেদনাবিধুর কাহিনী অবলম্বণে সিনেমাটি নির্মাণ হয়েছে।
ষোড়শ শতকের পূর্ব বাংলার হাওড় অঞ্চল। এ অঞ্চলের কবি দ্বিজ বংশীদাস ভট্টাচার্যের কন্যা চন্দ্রাবতী'র প্রেম হয় কবি জয়ানন্দের সাথে। চন্দ্রাবতীকে সাত পাকে বাধার প্রতিজ্ঞা করে জয়ানন্দ। বিশ্বাস ঘাতক জয়ানন্দ চন্দ্রাবতীর মন ভেঙ্গে বিয়ে করে একজন বিধর্মীকে। বেদনাহত চন্দ্রাবতী তাঁর বাবার নির্মিত শিব মন্দিরে নিজেকে গুটিয়ে নেন এবং মাতৃভাষায় 'রামায়ণ' পালা রচনায় ব্রতী হন। নিজে উপেক্ষিত হয়েছেন। মহাকাব্য রামায়ণে উপেক্ষিত হয় সীতা। তাই তাঁর রচিত রামায়ণ পালায় উপেক্ষিত সীতা হয়ে ওঠেন মূল চরিত্র।
এদিকে অনুশোচনায় পুড়ে ফিরে আসে জয়ানন্দ। ধ্যানমগ্ন চন্দ্রার মনে ঠাঁই হয়না ফিরে আসা জয়ানন্দের। জয়ানন্দ চন্দ্রার ধ্যান ভাঙতে না পেরে নিজের জীবন অবসান ঘটান। ধ্যান হতে উঠে চন্দ্রাবতী, জয়ানন্দের আত্মাহুতির ব্যাপারে জ্ঞাত এবং মর্মাহত হন। মর্মাহত চন্দ্রাবতী তাঁর জীবন উৎসর্গ করেন রামায়ণ পাঠ আর পালা লিখনে। এই কাহিনীটি আমাদের সবার অনেকেরই জানা, কিন্তু প্রায় চারশো বছর আগের এক কাহিনী এই সময়ে এসে সেলুলয়েডে তুলে ধরাটা মোটেও সহজ কাজ নয় একথা বলা যায় নিঃসন্দেহে।
২০১৬ থেকে ২০১৮ এই দুই বছরের নানা ঋতুতে ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, এগারো সিন্দুর জেলার বিভিন্ন লোকেশনে সিনেমাটির শুটিং অনুষ্ঠিত হয়। শুটিং শেষে বাংলাদেশ ও ভারতে সিনেমাটির নানা পর্বের পোস্ট প্রোডাকশন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ‘চন্দ্রাবতী কথা’ সিনেমার সহকারী পরিচালক হিসেবে আছেন রাজীব রাফি। 'ফোর কে' ডিজিটাল মাধ্যমে চিত্রগ্রহণ করেছেন সায়িদ কাশেফ শাহবাজী। স্থিরচিত্র গ্রহণ করেছেন রাওয়ান শায়েমা। চিত্র সম্পাদনা করেছেন পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত সম্পাদক শঙ্খজিত বিশ্বাস এবং সমীর আহমেদ। শব্দ গ্রহণ করেছেন সুকান্ত মজুমদার। শব্দ সম্পাদনা করেছেন রতন পাল। শিল্প নির্দেশনা দিয়েছেন তরুণ ঘোষ। সেট ডিজাইন করেছেন মাজহারুল রাজু। নৃত্য নির্দেশনা দিয়েছেন অমিত চৌধুরী। সাজ সরঞ্জাম ব্যবস্থাপনায় ছিলেন সাদ্দাম খন্দকার জয়। পোশাক সজ্জার দায়িত্বে আছেন নওরিন ফেরদৌস।
চন্দ্রাবতীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন দিলরুবা হোসেন দোয়েল। কবি জয়ানন্দ'র চরিত্রে আছেন ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ খ্যাত ইমতিয়াজ বর্ষণ। এছাড়াও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, মিতা রহমান, কাজী নওশাবা আহমেদ, গাজী রাকায়েত, আরমান পারভেজ মুরাদ, জয়িতা মহলানবিশ, বলরাম কর্মকার সহ স্থানীয় থিয়েটারের অভিনয় শিল্পীবৃন্দ।
চন্দ্রাবতী কথা’ চলচ্চিত্রে স্থানীয় গ্রামবাসীদের সাথে অভিনয় ও গানে অংশ নেন পালাগান ও জারীগানের প্রথিতযশা শিল্পী-খোকন বয়াতী, হামিদ বয়াতী, লালমিয়া বয়াতী প্রমুখ। এছাড়া একটি বিচ্ছেদী ভাটিয়ালী গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তরুণ কণ্ঠশিল্পী শংকর।
সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ম্যানগ্রোভ পিকচারস ও বেঙ্গল ক্রিয়েসন্স-এর প্রযোজনায় ‘চন্দ্রাবতী কথা’র ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালে। ২৫ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দর্শকদের কাছ থেকে ভূয়সী প্রশংসা লাভ করে সিনেমাটি। ২০১৯ সালেই ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা শহরে অনুষ্ঠিত ১৪ তম জগজা-নেটপ্যাক এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও সিনেমাটি প্রদর্শন করা হয়। এছাড়াও রাশিয়া এবং ভারতের আরো দু’টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘চন্দ্রাবতী কথা’ আমন্ত্রিত ও প্রদর্শিত হয়। বর্তমানে সিনেমাটি অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে অনুষ্ঠিতব্য 'এশিয়া প্যাসিফিক স্ক্রিন এওয়ার্ড- ২০২০' এ বাংলাদেশের একমাত্র কাহিনীচিত্র হিসেবে পুরস্কারে অংশ নেবার জন্য নির্বাচিত হয়েছে। এরই মাঝে সেন্সর সার্টিফিকেট প্রাপ্তি অবশ্যই পুরো টিমের জন্য আনন্দদায়ক।
ময়মনসিংহ গীতিকার কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত এই সিনেমার পরিচালক এন রাশেদ চৌধুরী জানিয়েছেন করোনা পরিস্থিতিতে স্কুল- কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ আছে, সামনে রোজা তাই রোজার ঈদের পরে পরিস্থিতি আরো একটু স্বাভাবিক হলে একটি সুবিধাজনক তার পরিচালিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘চন্দ্রাবতী কথা’ মুক্তি দেয়া হবে। বাংলাদেশের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতীর জীবনের কাহিনী সেলুলয়েডের পর্দায় নান্দনিকতার সাথে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে সেই সময়ে, এটাই কামনা।