
যখন কোনো একটা সিনেমা হিট হয়, তখন আসলে সবচেয়ে বেশি লাভবান কে হন? সিনেমার পরিচালক? প্রযোজক? নাকি, ডিস্ট্রিবিউটর? সিনেমার এই যে বিজনেস, এ বিজনেসে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা কার? সিনেমা ফ্লপ হলে অভিনেতার দায়ও বা কতটুকু? কীভাবে ব্যবসা করে বলিউডের সিনেমাগুলো? সিনেমা হল নাকি ওটিটি-টিভি রাইটসের সম্মিলিত আয়, ফ্লপ-হিটের প্যারামিটারটাই বা কী?
যখন কোনো একটা সিনেমা হিট হয়, তখন আসলে সবচেয়ে বেশি লাভবান কে হন? সিনেমার পরিচালক? প্রযোজক? নাকি, ডিস্ট্রিবিউটর? সিনেমার এই যে বিজনেস, এ বিজনেসে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা কার? সিনেমা ফ্লপ হলে অভিনেতার দায়ও বা কতটুকু? কেন আজকাল পারিশ্রমিকের বদলে অনেক অভিনেতাই যুক্ত হচ্ছেন প্রফিট শেয়ার টেকনিকের সাথে? তাতে লাভটাও বা কী? সিনেমার এই বিজনেস মডেল রান করেও বা কিভাবে? অজস্র সব প্রশ্ন। এক এক করে প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা যাক।
বলিউডের বিজনেস মডেল দিয়ে উদাহরণ দিলে রিলেট করতে পারা যাবে বেশ ভালোভাবে। অবশ্য, পার্টিকুলারলি 'বলিউড'কেই বেছে নেবার কারণও আছে। প্রথমত- সারা পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক সিনেমা বানানো হয় ভারতে। গড়ে প্রায় ২০০০ সিনেমা প্রতিবছর নির্মিত হয় এখানে। আর, ভারতে যত সিনেমা হয়, তার বিজনেসের অনেকটুকুই দখলে রাখে বলিউড। ভারতের মোট সিনেমার ১৬% বলিউডে তৈরী হলেও মার্কেট শেয়ার বলিউডের বেশি। গড়ে ৪৫% রেভিনিউ তারাই জেনারেট করে। সুতরাং, কেস স্টাডি হিসেবে 'বলিউড'ই যে রাজযোটক, সেখানে সংশয় থাকা উচিত না কারোরই।
যদিও, বলিউড যে সবচেয়ে বেশি রেভিনিউ জেনারেট করে, এই ন্যারেটিভ এখন খানিকটা পাল্টেছে। প্যান্ডেমিকের সময়ে এসে অনেককিছুর পাশাপাশি পাল্টেছে ভারতের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির পাশার দানও। বলিউডকে টপকে এখন সবচেয়ে বেশি রেভিনিউ আসে সাউথ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি থেকে। ৫৯% রেভিনিউ আসে সেখান থেকে। অর্থাৎ, বলিউডের একচ্ছত্র ক্ষমতাটুকু যে মহামারীর বদৌলতে বেশ ভালোভাবেই কমেছে, সেটা এই উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট। তবে, যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে, যদি বলিউড ভালো ভালো কিছু প্রজেক্ট আনতে পারে, তাহলে বি-টাউনের পক্ষে কামব্যাক করাটাও যে অসম্ভব কিছু হবেনা, সেটাও এক প্রকার নিশ্চিত।
এবার আসি, এই যে টাকাপয়সা কিংবা রেভিনিউয়ের কথা বললাম, এগুলো কিভাবে ভাগ-বাটোয়ারা হয় সে প্রসঙ্গে। প্রথমেই জেনে রাখি, বলিউডের একটা গড়পড়তা সাদামাটা মেইনস্ট্রিম সিনেমার বাজেটও কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকা! আবার, এই ইন্ডাস্ট্রিতে 'ব্রহ্মাস্ত্র' এর মত সিনেমাও আছে, যে সিনেমার বাজেট ৩০০ কোটি টাকা! অর্থাৎ, স্পষ্ট এটাই, টাকার অঙ্ক মোটেও কম না। এবং, এ টাকা কোনো একজন ব্যক্তির পক্ষে দেয়া সম্ভবও না। ফলে, যেটা হয়, সিনেমা বানানোর আগে প্রোডিউসার এর দরকার পড়ে। যে প্রোডিউসার, বা, একাধিক প্রোডিউসার মিলে কোনো একটা সিনেমায় লগ্নি করেন। এবার, যদি সিনেমাটা সুপারহিট হয়, তো, লাভ। আর, যদি সিনেমা ফ্লপ করে, তাহলে প্রোডিউসারের ভরাডুবি। অর্থাৎ, পুরো বিষয়টাই রেসে বাজি ধরার মত। কারণ, কোন সিনেমা যে বক্স-অফিসে হিট হবে, আর কোন সিনেমা হবে ফ্লপ, সে সম্পর্কে একমাত্র স্রষ্টা ছাড়া আর কেউ সঠিক নিদান দিতে পারবেন বলেও মনে হয় না৷
যাই হোক, তবুও প্রোডিউসাররা রিস্ক নেয়। সিনেমায় টাকা ঢালে। এ টাকা থেকে নায়ক-নায়িকার পারিশ্রমিক দেয়া হয়। পরিচালকের বেতনও দেয়া হয়। শুটিং, লোকেশন, ক্রু'সহ বাকিসব খরচও দেয়া হয়। তবে, এখানেও আছে খানিকটা অন্য হিসেব। সেটি হচ্ছে- অনেক অভিনয়-শিল্পী আছেন, যারা পারিশ্রমিকের বদলে সিনেমার সাথে 'প্রফিট শেয়ার অ্যাগ্রিমেন্ট' করেন। অর্থাৎ, সিনেমা হিট হলে, যতটুকু হিট হবে, তার উপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট পরিমাণ শেয়ার তিনি নেবেন৷ উদাহরণ হিসেবে আমির খানের নাম আসবে, যিনি মূলত এই কাজটি করেন। তিনি 'জিরো স্যালারি' পলিসিতে যুক্ত হন সিনেমার সাথে। সিনেমা হিট হলে, মোট আয়ের নির্দিষ্ট এক অংশ তিনি নেন৷ সিনেমা ফ্লপ হলে সিনেমার লসে তিনিও থাকেন স্টেকহোল্ডার। আবার, এমনি ভাবে, অনেক পরিচালকও যুক্ত হন সিনেমায়। কেউ একটা নির্দিষ্ট বেতনের বিনিময়ে সিনেমা পরিচালনা করেন। আবার, কেউ কেউ 'প্রফিট শেয়ার অ্যাগ্রিমেন্ট' এ যুক্ত হন।

অর্থাৎ, বোঝা গেলো, 'প্রফিট শেয়ার অ্যাগ্রিমেন্ট' এ যদি নায়ক-পরিচালক যুক্ত হন, তবে তাদের দায় আছে। কিন্তু এই অ্যাগ্রিমেন্ট ছাড়া যদি কোনো নায়ক অথবা পরিচালক সিনেমার সাথে যুক্ত হন, তাহলে সিনেমা হিট অথবা ফ্লপ, তাদের কোনো দায় নেই। পুরো দায় প্রোডিউসারের৷ তবে, পুরো দায় প্রোডিউসারেরও থাকেনা অনেকক্ষেত্রে। কারণ, কিছুক্ষেত্রে বার্ডেন শিফট হয় ডিস্ট্রিবিউটরের উপরেও। কিভাবে? সেটাই বলছি।
তার আগে বুঝতে হবে, সিনেমার প্রোডিউসার কিংবা ডিস্ট্রিবিউটর একই কোম্পানি হতে পারে। যেমন- বড় বড় প্রোডাকশন হাউজ- ধর্ম প্রোডাকশন, ইয়াশ রাজ ফিল্মস কিংবা এক্সসেল এন্টারটেইনমেন্ট... তারা তাদের সিনেমার প্রমোশন নিজেরাই করে অনেকক্ষেত্রে। আবার, অনেকক্ষেত্রে তারা ডিস্ট্রিবিউটরও হয়। যেমন- 'কেজিএফ টু' এর হিন্দি বেল্টে ডিস্ট্রিবিউটর ছিলো এক্সসেল এন্টারটেইনমেন্ট। তারা প্রোডিউসার ছিলোনা৷ অর্থাৎ, সিনেমা অনুযায়ী, প্রোডিউসার ও ডিস্ট্রিবিউটর এর চরিত্র পালটায়।
এবার, যদি, প্রোডিউসার আর ডিস্ট্রিবিউটর একই হয়, তাহলে কিছু বলার নেই। কিন্তু, যদি প্রোডিউসার আর ডিস্ট্রিবিউটর হয় ভিন্ন, তাহলে তাদের বিজনেস মডেল তিন রকম হতে পারে।
প্রথমত, মিনিমাম গ্যারান্টি রয়াল্টি (ফিক্সড অ্যামাউন্ট)। এই প্রসেসে যেটা হয়, একটা নির্দিষ্ট অ্যামাউন্টের টাকা ডিস্ট্রিবিউটর, প্রোডিউসারকে দেয়। এবং, সিনেমার প্রমোশন শুরু করে। পরবর্তীতে, যদি সিনেমা হিট করে, তাহলে আরো কিছু শতাংশ শেয়ার প্রোডিউসার পায়। এ প্রসেসে তাই যেটা হয়, রিস্ক দুই পক্ষেই থাকে। প্রোডিউসার আর ডিস্ট্রিবিউটর... দুইজনকেই কিছু বার্ডেন শেয়ার করতে হয়।
দ্বিতীয়ত, প্রোডিউসার পুরো সিনেমা কমপ্লিটলি ডিস্ট্রিবিউটর কে বিক্রি করে দেয়। এরপর এই সিনেমা নিয়ে বাকি যা খুশি হোক, সব ডিস্ট্রিবিউটর-ই করবে। এখানে প্রোডিউসারের আর বলার কিছু থাকেনা। এ প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, রাজ কাপুরের 'মেরা নাম জোকার' সিনেমার কথা। সে সময়ের এক কোটি টাকায় বানানো হয়েছিলো সিনেমাটি। কিন্তু, সিনেমাটি আয় করে ৮০ লাখ টাকা। ফলাফল- ফ্লপ। পরে, রাজ কাপুর হতাশ হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের এক ডিস্ট্রিবিউটরের কাছে ১৫ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন সিনেমাটি। অর্থাৎ, সিনেমার সব দায়দায়িত্ব নিকেশ করে ডিস্ট্রিবিউটর এর কাছে শিফট করেন তিনি।

এবং, মূলত, তার পরেই হয় চমক। সোভিয়েত ইউনিয়নে সিনেমাটি ব্লকবাস্টার হিট হয়। ১৬.৮১ কোটি টাকা ইনকামও করে। যে টাকা, বর্তমানের হিসেবে প্রায় ১০০৭ কোটি টাকা! যদিও এই বিশাল লাভের সিকিভাগও রাজ কাপুর পাননি। কারণ, রাজ কাপুর ডিল-ই করেছেন সেভাবে। ফলাফল, নিজের সিনেমার লোকসান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাকে।
এবার আসি, তৃতীয় প্রসেসে৷ এই প্রসেসে, প্রোডিউসার, ডিস্ট্রিবিউটর কে সিনেমা দেবে কমিশন বেসিসে। কমিশন ওয়াইজ কাজ হবে। এখানে রিস্ক মূলত প্রোডিউসার এর। ডিস্ট্রিবিউটরের না। এখানে ডিস্ট্রিবিউটর শুধুমাত্র কমিশন অনুযায়ী কাজ করবে। বাকিসব ক্ষেত্রে তার কোনো দায় নেই।
যদি প্রোডিউসার-ডিস্ট্রিবিউটর এর এই বিজনেস পলিসি আমরা বুঝে থাকি, তাহলে আরেকটু গভীরে যাবো এবার। এবং সে গভীরে গিয়ে আমরা পাবো- সাব ডিস্ট্রিবিউটর'দের। এই সাব-ডিস্ট্রিবিউটররা তৃনমূল পর্যায়ের লোক। ডিস্ট্রিবিউটররা, প্রোডিউসারদের সাথে বিজনেস ডিল করার পরে যেটা করে, তা হচ্ছে, সিনেমাকে সাব-ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছে দিয়ে দেয়৷ গোটা ভারতকে আলাদা আলাদা সার্কিটে ভাগ করে সেখানে সাব-ডিস্ট্রিবিউটরদের নিয়োগ করা হয়।
সাব-ডিস্ট্রিবিউটররা, ডিস্ট্রিবিউটর এর কাছ থেকে অ্যাসাইনমেন্ট পাবার পরে, সার্কিট ওয়াইজ এক্সিবিউটরদের সাথে ডিল করে। সিনেমা প্রচারের অ্যারেঞ্জমেন্ট করে। এখানে জেনে রাখা ভালো- এক্সিবিউটর মানে, যারা সিনেমাটা দর্শককে দেখাবে। অর্থাৎ, সোজা বাংলায়- হলের মালিকেরাই এক্সিবিউটর।
এবার আসি সিনেমা হলের হিসেবে। দুই রকমের সিনেমা হল আছে। প্রথমত, সিঙ্গেল স্ক্রিন। এই 'সিঙ্গেল স্ক্রিন' এ যা ইনকাম, তার ২৫% পায় হল মালিক। ৭৫%, মানে, বাকিটা যায় সাব-ডিস্ট্রিবিউটর এর কাছে। সেখান থেকে ডিস্ট্রিবিউটর, আর, সেখান থেকে প্রোডিউসার। এভাবেই ডিস্ট্রিবিউশন হয়৷ তবে, এই যে ২৫-৭৫ রেশিও, এটা কমবেশি হতে পারে। হতে পারে ২০-৮০ অথবা ৩০-৭০ ও।
দ্বিতীয় রকমের সিনেমা হল থাকে শপিংমলের ভেতরে, যাকে আমরা 'মাল্টিপ্লেক্স' বলে চিনি। এবার, এই মাল্টিপ্লেক্সের রেশিওটা ভিন্ন। এখানে প্রথম সপ্তাহে এক্সিবিউটর আর ডিস্ট্রিবিউটর এর রেশিও থাকে ফিফটি ফিফটি। সেকেন্ড উইকে এসে ডিস্ট্রিবিউটর এর রেশিও কমে হয় ফোর্টি। মডেল দাঁড়ায় ৬০-৪০ এ। সেখান থেকে ৩০-৭০, ২০-৮০ এভাবেই ক্রমশ কমতে থাকে।

এবার প্রশ্ন আসে, এই যে সিনেমাহলের প্রফিট, এটা কই থেকে আসে? উত্তর- বক্স অফিস থেকে। প্রশ্ন- বক্স অফিস কী? উত্তর- যে টিকেট কাউন্টার থেকে টিকেট কেনা হয়, সেটাই বক্স অফিস। এবার, এই যে টিকেটের টাকা, এটা সরাসরি থিয়েটার মালিকের কাছে যায়। সে টাকা থেকে সরকারকে ট্যাক্স অর্থাৎ জিএসটি দিতে হয়। জেনে রাখা ভালো, 'জিএসটি'র আগে এন্টারটেইনিং ট্যাক্স দিতে হতো। এখন লাগেনা। যাই হোক, ১৮% জিএসটি দিতে হয়, যখন টিকেটের দাম হয় ১০০ টাকার থেকে বেশি। আবার, ১২% জিএসটি দিতে হয়, যখন টিকেটের দাম হয় ১০০ টাকার কম। এবার, এরকম জিএসটি দেবার পর যা থাকে, সেটাই নেট কালেকশন। এবং, এ কালেকশনটাই ভাগ হয় স্টেক হোল্ডারদের মাঝে।
মূলত, একটা সিনেমার নেট কালেকশন কত, তা থেকেই বোঝা যায় সে সিনেমার দৌড়। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, ওটিটিতে বিক্রি, টেলিভিশনে 'ওয়ার্ল্ড টিভি প্রিমিয়ার' এর মাধ্যমেও কিছু ইনকাম হয় সিনেমার। সেগুলোও যোগ হয় নেট কালেকশনের সাথে। এবং মূলত এভাবেই আয় করা অর্থে সওয়ার হয়ে চলে বলিউডের এই বিজনেস মডেল। এখানে প্রোডিউসাররা যদিও অনেকটাই রিস্ক ক্যারি করেন, তবে সাম্প্রতিক সময়ে ডিরেক্টর, অ্যাক্টররাও এই 'রিস্ক প্রসেস' এর সাথে যুক্ত থাকায়, বার্ডেন খানিকটা হলেও কম তাদের। ফলে, পরিবেশটাও আগের চেয়েও অনেক বেশি সাসটেইনেবল। হেলদি।