
গত বছর মুক্তি পাওয়া 'বঙ্গ বব' সিরিজটি অনেকগুলো সংস্কারকে ভেঙ্গেছিল। বইয়ের গল্প/উপন্যাস থেকেও যে দুর্দান্ত নাটক হতে পারে, তা দেখিয়েছে। প্রেম আর সস্তা ভাঁড়ামোর বদলে বুদ্ধিদীপ্ত কনসেপ্টের গল্প দেখলে মানুষ যে বেশি তৃপ্তি পায়, সেটারও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে...
গত বছর স্ট্রিমিং সাইট 'বঙ্গ' যখন সাতজন লেখকের গল্প নিয়ে নাটক নির্মাণের ঘোষণা দেয়, খুশির পাশাপাশি শঙ্কাও হচ্ছিলো। ঠিকঠাক সব হবে তো? নাটকগুলোতে 'বাজারি' উপাদান ঢুকিয়ে সব খেলো করে দেয়া হবে না তো? পুরো সিরিজ দেখা শেষ করার পরে এটাই বলার ছিল- ২০২১ সালে রোজার ঈদের সবচেয়ে সেরা কাজ এটিই। প্রতিটি চমৎকার গল্পের বিপরীতে দুর্দান্ত সব নির্মাণ; যেন এক নাটকের সাথে প্রতিযোগিতা হচ্ছিলো আরেক নাটকের। কার থেকে কে সেরা? তা নিয়ে তুমুল দড়ি টানাটানিও চলেছিল এক সপ্তাহ জুড়ে। জেনে নেয়া যাক, সে দড়ি টানাটানির ময়নাতদন্তের রিপোর্ট।
১. শহরে টুকরো রোদ
শাহাদুজ্জামানের 'মামলার সাক্ষী ময়নাপাখি' বইয়ের দুটি গল্প অবলম্বনে 'শহরে টুকরো রোদ' নাটক নির্মিত হওয়ার সংবাদে প্রত্যাশা খানিকটা বেশিই ছিলো। এবং নূর ইমরান মিঠু সেই প্রত্যাশার পারদ নিচে নামতে তো দেনইনি৷ বরং দারুণ এক ট্রিবিউট দিয়েছেন গল্পগুলোকে৷ বিশেষ করে দ্বিতীয় গল্পটিকে।
'শহরে টুকরো রোদ' নাটকে দুটি গল্প, আলাদা আলাদা ভাবে বলা হয়েছে৷ প্রথম গল্প- শহরে। যেটা শাহাদুজ্জামানের 'উবার' গল্প থেকে নেয়া। ঘটনার ব্যাপ্তির দিক থেকে চিন্তা করলে এ গল্প নাতিদীর্ঘ ব্যাপ্তির।

এক রহস্যময় মহিলা, উবারে করে আসেন রাজধানীর কোনো এক সড়কের প্রান্তে। গাড়ির মধ্যে বসেই আধুনিক পোশাকের উপরে বোরকা পড়েন। এরপর ঢুকে যান অভিজাত এক পাঁচতারকা হোটেলে? কেন? কী উদ্দেশ্য তার? ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে থাকেন তিনি, হোটেলের এখানে-ওখানে। কী জন্যে তার এমন সন্দেহজনক গতিবিধি? কেন তার আচরণে ত্রাসের সঞ্চার হয় গোটা হোটেলে?
যারা বইয়ের গল্প না পড়েই শুরু করবেন এ নাটক, তাদের কাছে বেশি ইন্টারেস্টিং লাগবে এই ট্রিটমেন্ট। সবমিলিয়ে ভালো ছিলো এ গল্প। তবে মাতামাতি করার মতন কিছু না।
শাহাদুজ্জামানের যে গল্প থেকে দ্বিতীয় নাটক, সে গল্পের নাম 'টুকরো রোদের মতো খাম।' নামটি এক অদ্ভুত সুন্দর উপমা!
দুর্দান্ত সেই উপমার গল্পটাই এই নাটকে 'টুকরো রোদ' নামে দেখানো হয়েছে। পুরোটাই ব্রিলিয়ান্ট কনসেপ্টের এক গল্প! গল্প শুরু এক কর্পোরেট অফিসার, আন্দালিব কে দিয়ে। যিনি সারাদিন অফিসের নানা কাজে মেইল করেন বিভিন্ন মানুষকে। আর ক্রমশ মিস করতে থাকেন হাতে লেখা চিঠির দিনগুলোকে। যিনি অল্পপরিচিত পোস্ট-অফিসের এক কর্মীকে ফোন করে উদগ্রীব হয়ে জানতে চান-
আচ্ছা ফারুক, মানুষ কি এখনো চিঠি লেখে?
এরপর চলে যান পোস্ট-অফিসে। হাতে লেখা চিঠি দেখার আশায়। বেহায়ার মতন চেয়ে কিছু বেওয়ারিশ চিঠি নিয়েও আসেন সাথে করে। সেই চিঠিগুলোর মধ্যে পান এক ফাঁসির আসামীর চিঠি৷ পড়া শুরু করেন। গল্পের মোড় ঘুরে যায় এরপরেই। বইয়ে এ গল্প পড়ে যতটা ভালো লেগেছিলো, পার্থ বড়ুয়ার অভিনয়, নূর ইমরান মিঠুর দারুন ন্যারেশন স্টাইল এবং অল্প লয়ের এক ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর...নাটকটাও ঠিক ততটাই চমৎকার লেগেছে।
নুর ইমরান মিঠু'কে নিয়ে ভালো প্রত্যাশাই ছিলো। শাহাদুজ্জামানের গল্প অবলম্বনে তাঁর নির্মিত 'কমলা রকেট' দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। 'শহরে টুকরো রোদ' দেখে আরেক দফা মুগ্ধ হয়েছি।
২. মরণোত্তম
নবীন কথাসাহিত্যিক সাদাত হোসাইনের 'মরণোত্তম' উপন্যাস অবলম্বনে সঞ্জয় সমাদ্দারের 'মরণোত্তম' সবমিলিয়ে মনে রাখার মতনই এক কাজ। কেন? তার পেছনে আছে কয়েকটি কারণ। একে একে বলছি।
প্রথমে আসি চরিত্রে। এ নাটকে কারা আছে? এ নাটকে আছে এক সৎ স্কুলশিক্ষক,আছে এক প্রভাবশালী অসৎ চেয়ারম্যান, আছে চেয়ারম্যানের কুলাঙ্গার ছেলে, সে সাথে আছে এক অসহায় মেয়ে। যেই অসহায় মেয়েকে নিয়মিত উত্যক্ত করে প্রভাবশালী চেয়ারম্যানের কুলাঙ্গার ছেলে। স্কুল-শিক্ষক এই নির্যাতিতা মেয়ের হয়ে বারবার ধর্না দেন চেয়ারম্যানের কাছে। এই অন্যায়ের বিচার করতে বলেন তাকে। লাভ হয় না কোনো। শেষে আসে অন্তিম পরিণতি। এরপরে আসে সেই বিশেষ শব্দের ভূমিকা 'মরণোত্তম।' মূল গল্প সাদাচোখে এটুকুই।

চিত্রনাট্যের দুয়েকটা জায়গায় খুঁত ছিলো, আরেকটু টানটান হতে পারতো ঘটনার পরম্পরা, আরেকটু ডেপথে গিয়ে দেখানো যেতো চরিত্রগুলোর টানাপোড়েন... সেগুলো অনায়াসে বাদ দেয়া যায়, শুধুমাত্র মূলগল্পের প্রাসঙ্গিকতার কারণে। 'ধর্ষণ'কে উপজীব্য করে মানুষের সামাজিক সংকীর্ণতা, সামষ্টিক আত্মকেন্দ্রিক সংকীর্ণতা, সামাজিক মাধ্যমের সর্বভুক আগ্রাসী লোলুপতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি... সবই উঠে এসেছে এই নাটকে৷ পারস্পরিক সামঞ্জস্য মিলিয়ে।
ইলিয়াস কাঞ্চন, শহিদুজ্জামান সেলিম...এদের নিয়ে প্রত্যাশা সবসময়েই বেশি থাকে। এবারেও ছিলো। বরাবরের মতনই হতাশ করেনি তারা। স্বাভাবিক অভিনয়ই করেছেন৷ খুব যে অসাধারণ হয়েছে অভিনয়, তাও বলবো না৷ যেটা দরকার ছিলো, সেটাই দিয়েছেন তারা৷ এরমধ্যে আলাদাভাবে মুগ্ধ করেছে- ইমতিয়াজ বর্ষণ। সহজাত এক ভঙ্গি আছে এই অভিনেতার মধ্যে। আশা রাখি, সামনে তার আরো কাজ দেখতে পাবো। কোহিনূর, রাকিব, রফিক... এই চরিত্রে অভিনয় করা বাকিরাও ভালোই সঙ্গত দিয়ে গিয়েছেন গোটা নাটকে।
সঞ্জয় সমাদ্দারের এই কাজটা এমনিতেও সুন্দর হয়েছে। সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই। কিন্তু আমি এই কাজটিকে মনে রাখবো শুধুমাত্র এর ভেতরের গূঢ় বার্তাটির জন্যে। মানুষ যে আসলে বাঙ্গির চেয়েও সস্তা...এই ধাক্কাটা মানুষের পাওয়া উচিত। নিয়মিত। ক্রমাগত। সেজন্যে এরকম নাটক, সিনেমা, গল্প, উপন্যাস যদি সহস্রাধিকও নির্মাণ করতে হয়, করা উচিত। এভাবেই হয়তো সমাজ জাগবে। সামাজিক নানা সংকটে নিস্পৃহ থাকতে থাকতে আমাদের যে অভ্যেস দাঁড়িয়ে গিয়েছে সময়ের ফেরে, সেটার মূলেও এক বড়সড় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে এই নাটক। সে কারণেই এ নাটক সার্থক।
৩. লাবণী
এক অদ্ভুতুড়ে বই আর সে বইয়ের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা কিছু মানুষ ও তাদের ভাগ্যের বিড়ম্বনা নিয়ে দারুণ এক নির্মাণ 'লাবণী।' এই ঈদে আমার দেখা সবচেয়ে সেরা কাজ এটিই।
অন্যরকম এবং ব্যতিক্রমী ঘরানার এক সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার হিসেবেই আবর্তিত হয়েছে পুরো চিত্রনাট্য। যদিও এটাকে 'হরর থ্রিলার' ট্যাগ দেয়া হয়েছে। তবে দ্ব্যর্থকভাবেই, মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনের এক প্রখর নির্মাণ এটি। নাটকের ভিন্ন ভিন্ন টাইমলাইনে যে গল্পগুলো দেখানো হয়েছে, তা দুর্দান্ত। ঘটনাপ্রবাহ'র গতিশীলতা তটস্থ রেখেছে নাটকের পুরোটা সময়েই। এক চুল চোখ এবং মনোযোগ সরানো যায়নি, পারিনি। ক্ষণেক্ষণেই ভেবেছি, এই গল্পের মালমশলা আরেকটু বাড়ালে, আরো কিছু চরিত্র এবং সাসপেন্স-টুইস্ট যোগ করলে, অনায়াসে একটি দারুণ চলচ্চিত্র বানানো সম্ভব ছিলো।
মারুফ রেহমানের 'লাবনী' গল্প পড়া ছিলো না। কিন্তু তার এই গল্প অবলম্বনে কিসলু গোলাম হায়দারের পরিচালনায় নাটকটি হয়ে রইলো জীবনানন্দের 'আট বছর আগে একদিন' কবিতার মত বাস্তব ও পরাবাস্তবের মিশেল জংশন। ছিপছিপে, মেদহীন চিত্রনাট্য আর কুশীলবদের দারুণ অভিনয়ে পুরোটাই হয়ে রইলো দারুণ এক অভিজ্ঞতা। হয়তো, অনেকদিন মনেও থাকবে এই কাজটি।

নাটকের মূখ্য চরিত্রের অভিনেতা মনোজ প্রামাণিক দারুণ কাজ করলেন। ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র আলাদাভাবে পর্দায় দেখানো, মানসিক জটিলতার ভুক্তভোগী হিসেবে বেসামাল আচরণ...সবই খুব দক্ষভাবে সামলালেন তিনি। নাটকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন টয়া। 'লাবনী' চরিত্রে তিনি খারাপ করেননি। খুব অসাধারণ করেছেন তাও বলা যাবে না। 'আসলাম' চরিত্রে অভিনয় করা শাহাদাৎ হোসেনের অভিনয় দারুণ লেগেছে। খুব অল্পকিছু ডায়লগ ছিলো তার। কিন্তু সবগুলোই জ্যান্ত জ্যান্ত ডায়লগ। ডায়লগ ডেলিভারিও খুবই স্বতঃস্ফূর্ত। আরোপিত মনে হয়নি কিছুই। গুরুত্বপূর্ণ আরেক চরিত্রে ছিলেন আয়নুন পুতুল। তিনি হয়তো আরেকটু ভালো করতে পারতেন। উন্নতির সে জায়গা ছিলো অনেকটাই। বাকিরা ঠিকঠাক।
এ নাটকটা দেখে উচ্ছ্বসিত হয়েছি এ কারণে বাংলাদেশে 'সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার' জনরা নিয়ে খুব কম কাজ হয়। যেগুলো হয়, সেগুলোও অপ্রাসঙ্গিক চিত্রনাট্য, কাঁচা অভিনয় আর অতিমাত্রায় 'অদ্ভুতুড়ে' অনুষঙ্গ মিলিয়ে কেঁচেগণ্ডূষ করে পুরো কাজের কফিনে পেরেক ঠুকে দেয়া হয়। ঠিক সে জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে 'লাবনী' এক ভিন্ন উদাহরণ। কী নাটক, কী চিত্রনাট্য, কী অভিনয়... কোনো জায়গাতেই একবিন্দু খামতি নেই। অবহেলার লেশমাত্র নেই পুরো নির্মাণের জায়গাটিতে।
'লাবনী' অসাধারণ কাজের এক নির্মল তৃপ্তি দিয়েছে। আশা রাখি, সাইকোলজিক্যাল জনরায় এদেশে আরো কাজ হবে। বলাই বাহুল্য, সামনে যারাই এই ধরণের কাজ করবেন, তাদের জন্যে পথিকৃৎ হয়ে থাকবে এই নাটকটি।
৪. মিস্টার কে
মাহবুব মোর্শেদের 'নোভা স্কশিয়া' উপন্যাস অবলম্বনে ওয়াহিদ তারেকের চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় 'মিস্টার কে' আরেকটি দুর্দান্ত নাটক। কিছুটা কল্পবিজ্ঞান, কিছুটা মানবিক টানাপোড়েন আর কিছু ছিমছাম রহস্য মিলেমিশে এ নাটক এগোয় সামনে।
নাটকে আমরা দেখি ডক্টর আনাম'কে। যিনি পেশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিন্তু তার ক্লাস কেউ খুব একটা পছন্দ করে না। তাই তিনি লাইব্রেরিতেই বেশিরভাগ সময় কাটান। স্ত্রী, কন্যা থাকে কানাডায়৷ বউয়ের সাথে খিটিমিটি সারাদিন লেগেই থাকে।
এমন এক খিটিমিটির দিনে তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় প্রয়াত এক শিল্পপতি, খান-এ-কায়কোবাদের সন্তান খান-এ-মিজান। অপহরণের পরে তাকে নিয়ে আসা হয় মিজানের কাছে৷ মিজান তাকে দেয় এক অদ্ভুত প্রস্তাব৷ মিজানের বাবা কায়কোবাদ নাকি বাহামার কোনো একটি ব্যাংকের লকারে রেখে গিয়েছে অঢেল সম্পত্তি৷ কিন্তু সেই লকারের পাসওয়ার্ড দিয়ে যায়নি কাউকেই৷ এখন ডঃ আনামকে সেই পাসওয়ার্ড বের করতে হবে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই কাজে ডঃ আনাম কিভাবে সাহায্য করতে পারবেন? উত্তর হলো, তিনিই পারলে পারবেন৷ আর কেউ না। অনুমানবিদ্যা নামক কনসেপ্ট নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি৷ একটা মানুষের সবকিছু নকল করে সেই মানুষের জীবন কয়েকদিন যাপন করলেই উঠে আসে নানারকম তথ্য৷ এভাবেই হয়তো পাওয়া যাবে পাসওয়ার্ড। শুরু হয় পাসওয়ার্ড বের করার মিশন।

গল্পটা যে অনেকটাই অন্যরকম, তা এটুকু পড়েই সচেতন পাঠকের বুঝে ফেলার কথা৷ ইন্টারেস্টিং গল্পকে যোগ্য সাপোর্ট দিলেন পার্থ বড়ুয়া, শাহেদ শরিফ খান, সুষমা সরকার, নাজিয়া হক অর্ষা।
তবে চিত্রনাট্য আরেকটু টানটান হতে পারতো। কয়েক জায়গায় ঝুলে গিয়েছিলো খানিকটা। আরেকটা বিষয়- 'মিঃ কে' কে এক ঘন্টার নাটকের ছাঁচে ঢোকানোর জন্যে অনেকটাই কাটাকুটির খেলা দেখাতে হয়েছে স্ক্রিপ্টে। সবকিছু অক্ষত রেখে অনায়াসেই একটা সিনেমা হয়ে যেতো এই গল্পে। আফসোস, তা হয়নি৷ ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর কয়েক জায়গায় খুবই সুন্দর। আবার কয়েক জায়গায় খুবই সাধারণ। এ দিকে আরেকটু যত্ন নেয়ার দরকার ছিলো৷
সবমিলিয়ে সুন্দর এক কাজ৷ উন্নতির জায়গা ছিলো। কিন্তু যা হয়েছে, তাও দারুণ৷
৫. আলিবাবা ও চালিচার
শিবব্রত বর্মন এর উপন্যাস- আলিবাবা ও চালিচার অবলম্বনে অনিমেষ আইচ এর নাটক 'আলিবাবা ও চালিচার' ডার্ক কমেডি জনরার বেশ সুন্দর কিছু করার প্রচেষ্টা।
শৈশবে 'আলিবাবা ও চল্লিশ চোর' এর গল্প পড়েনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া অসম্ভবের কাছাকাছি একটা বিষয়৷ অনেক প্রাচীন একটা গল্পকে যদি বর্তমানের মোড়কে নিয়ে আসা হয়, তাহলে কেমন হবে? শিবব্রত বর্মনের সেই ভাবনাকেই নাটকে রূপান্তরিত করেছে অনিমেষ আইচ৷

মহম্মদ আলী (না, তিনি বক্সার নন) এক ছাপোষা মধ্যবিত্ত। তার পরিবারে আছে স্ত্রী, স্ত্রী'র ঘোড়েল বড় ভাই, কাজের মেয়ে এবং একটি বিড়াল; মর্জিনা৷ এই মহম্মদ আলী চাকরী হারিয়ে পথে পথে ঘুরতে একদিন সন্ধান পান 'চালিচার ফার্মা' নামের এক আজব ফ্যাক্টরির৷ ভাগ্যক্রমে সেখানে ঢোকার গেটপাসও পেয়ে যান তিনি। ঢুকে পড়েন সেখানে৷ গল্প মোড় খায় এরপরেই৷ আসতে থাকে একের পর এক চমক৷
এই নাটক জমিয়ে দেয়ার মতন অজস্র উপাদান ছিলো মূল গল্পে। কিন্তু অনিমেষ আইচের 'আলিবাবা ও চালিচার' কেন যেন জমতে গিয়েও জমলো না৷ সেটা হতে পারে নূর ইমরান মিঠু এবং আশনা হাবিব ভাবনার খাপছাড়া অভিনয়ের কারণে, হতে পারে স্ক্রিনপ্লে'র বিক্ষিপ্ত ছুটোছুটির কারণে। হতে পারে কমিক রিলিফগুলোর 'উইট লেভেল' কমে যাওয়ার কারণে। অনেকগুলো কারণের মধ্যে কোনটি আসলে মূখ্য কারণ, সেটা আলাদা করে বলা যাচ্ছে না৷
তবে নাটকে ভালো দিকও যে নেই, তা নয় মোটেও। সত্যজিৎ রায় এর 'নায়ক' কে ট্রিবিউট দিয়ে শুরু করা নাটক বেশ আশাই জাগিয়েছে প্রথম দিকে। পুরো নাটকে টুকরো টুকরো ব্রিলিয়ান্ট দৃশ্যের চমক ছিলো। 'ঝালমুড়িওয়ালা আয়নাল' চরিত্রে অভিনয় করা সোহেল মন্ডল ভালো করেছেন। মহম্মদ আলীর শালা 'কাশেম' চরিত্রে ইশতিয়াক আহমেদ রূমেলও উতরে গেছেন৷ কিন্তু বাকিরা চলনসই না। তথৈবচ অভিনয় তাদের৷
সবমিলিয়ে তাই এই নির্মাণটি মোটামুটি। খুব উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার মতন কোনো কাজ না৷ দেখা যেতে পারে। না দেখলেও ক্ষতি নেই৷
৬. কেমনে কি?
যোবায়েদ আহসান এর 'হাকুল্লা' উপন্যাস অবলম্বনে ইফতেখার আহমেদ ফাহমি'র 'কেমনে কি' নাটকের টাইটেল 'এইটা কিছু হইলো' দিলেও হয়তো সমস্যা হতোনা৷ গল্পের মূলভাব একই থাকতো।
নাটক শুরু হয় 'হাকুল্লা খাওন কিন্তু এত সহজ না....' এই লাইন দিয়ে। এখন কথা হচ্ছে, হাকুল্লা কী? পরবর্তীতে জানা গেলো- হাকুল্লা হচ্ছে চুরি করে বিয়ে খাওয়া। ঢাকা শহরেরই কোনো এক শঠ ব্যক্তি এভাবে প্রতিদিন হাকুল্লা খান৷ মাঝেমধ্যে ধরা পড়ে গেলে মারও খান৷ সেই লোকের সাথে পাকেচক্রে দেখা হয়ে যায় এক বিশাল বড়লোকের ছেলে অন্তুর। যে অনেকটা হুমায়ুন আহমেদের বিখ্যাত চরিত্র 'শুভ্র'র মতন। বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে খুব একটা ধারণা নেই যার। এই শঠ লোকটি, অন্তুকে নিয়ে যায় হাকুল্লা খেতে। কিন্তু এরপরেই ঘটতে থাকে একের পর এক অঘটন। আংটি, পুলিশ, বাদল ভাই...সব মিলেমিশে কেমন যেন অঘটনের মহোৎসব শুরু হয় অন্তুর জীবনে।

মূল গল্পটা ইন্টারেস্টিং। নাটকটাও মোটামুটি ভালোই। ফাহমি'র নাটক সবসময়েই ভালো৷ সে বেঞ্চমার্ক থেকে এই নাটক খানিকটা নীচে নামলেও খুব একটা খারাপ হয়নি। সোহেল খান, ইয়াশ রোহান, সিদ্দিক, বিশেষ দৃশ্যে- অপর্ণা ঘোষ সহ বাকিরা ভালোই অভিনয় করেছে৷
একটা টেকনিক্যাল সমস্যা লক্ষ্য করলাম 'কেমনে কি' নাটকে। 'বঙ্গ'র অ্যাপ দিয়ে নাটক দেখছিলাম। লক্ষ্য করলাম, শুটিং এর সময়ে ডিরেক্টরের ডিরেকশনের ভয়েসটা কেন যেন কাটতে ভুলে গিয়েছেন এডিটর। ফলে নাটক দেখতে দেখতে দেখছি, অদৃশ্য থেকে ডিরেক্টর বলছেন- মাথায় আঁচল দেন। সঙ্গে সঙ্গে চরিত্র মাথায় আঁচল দিচ্ছে। একটু অদ্ভুত লাগলো এটা। কয়েকটা সিনেই এরকম দেখলাম।
তখন মাথায় চলে এলো একটাই লাইন- কেমনে কি?
৭. চরের মাস্টার
রাহিতুল ইসলামের উপন্যাস 'চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার' অবলম্বনে ভিকি জাহেদের 'চরের মাস্টার' নাটক কনসেপ্টের দিক থেকে খুব একটা নতুন না। মানে, বাংলা সিনেমায় এরকম গল্প আমরা আকছার দেখি। গল্পে এক আদর্শ নায়ক আছে। যে চরের মানুষকে অশিক্ষা,কুশিক্ষা, কুসংস্কার,অন্যায়ের হাত থেকে বাঁচাতে চায়। সেখানে থাকে ভিলেন চেয়ারম্যান আর তার চ্যালারা। যার চায় গল্পের নায়ককে থামাতে। শেষপর্যন্ত কে জেতে, কে হারে, তাই নিয়েই গল্প।
তবে এই নাটকে চরকে কেন্দ্র করে এই অনুষঙ্গগুলো ব্যবহার করা হয়েছে, যেটা অডিয়েন্সকে একটু হলেও এদেশের চরগুলোর দুরবস্থা সম্পর্কে ধারণা দেবে। সাথে ডিজিটাল প্রযুক্তির বদান্যতা ও সুফলের রকমফের নিয়েও খানিকটা আঁচ দেয়া হয়েছে নাটকে। 'ওল্ড ওয়াইন ইন আ নিউ বটল' টাইপের বিষয় হয়ে গিয়েছে খানিকটা।

আমি যদি 'বঙ্গ বব' সিরিজের বাকি গল্পগুলোর সাথে তুলনা করি, তাহলে এই ওটিটি কন্টেন্ট একটু পিছিয়েই থাকবে। তবে চরের সিনেমাটোগ্রাফি দারুণ হয়েছিলো। সাথে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরটাও ভালো। 'দৃষ্টি থমকে যায়' গানটি হিট হয়েছে। অনেকেরই প্লেলিস্টে ঢুকে পড়েছে গানটি৷
খায়রুল বাসারের অভিনয় ভালো হয়েছে৷ সাফা কবিরের অভিনয় আরও ভালো হতে পারতো। মুগ্ধ করেছেন লুৎফর রহমান জর্জ। জাত অভিনেতারা এরকমই করে। মাসুম আজিজও দারুণ। বাকিরা চলার মতন। কারো অভিনয়ই খারাপ না।
সমস্যা শুধু গল্পে। আর কিছু না। সমসাময়িক আরো কিছু ইস্যু আনা যেতে পারতো এখানে। ক্লিশে বিষয়গুলো বাদ দেয়া যেতো। সেগুলো কাটছাঁট করলে 'চরের মাস্টার' নিয়ে হয়তো আরো কিছু ভালো কথা বলতে পারতাম। সেটার সুযোগ হয়নি।
'বঙ্গ বব' সিরিজ অনেকগুলো সংস্কারকে ভেঙ্গেছে। বইয়ের গল্প/উপন্যাস থেকে যে দারুণ সব নাটক হতে পারে, তা দেখিয়েছে। প্রেম-ভালোবাসা-সস্তা ভাঁড়ামোর বদলে দুর্দান্ত সব কনসেপ্টের গল্প নিয়ে এলে মানুষ যে আরো বেশি খুশি হয়, সেটার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তাছাড়া, সাহিত্য ও নাটক একত্রে হলে যে দারুণ এক ইন্দ্রজাল সৃষ্টি হয়, সেটিরও সুলুকসন্ধান দিয়েছে স্ট্রিমিং সাইট 'বঙ্গ।' এই ঈদে আসছে সিরিজের দ্বিতীয় সিজন। আশা করি, আরও ভালো কিছু উপহার দেয়ার ধারা বজায় রাখবে তারা। শুভকামনা।