পর্দার ক্যানভাসে 'প্রেম'কে এত রঙের বুনোটে যশ চোপড়ার মত আঁকতে পারেনি কেউই। 'প্রেম'কে এতভাবে বিশ্লেষণও করতে পারেনি কেউ। আর সে কারণেই, 'বলিউডি রোমান্টিক সিনেমা' বলতে এখনও যশ চোপড়াই হয়ে আছেন শেষ কথা। যার আগে কেউ নেই। সামনে কেউ কোনোদিন আসবে কি না, অনিশ্চিত সেটাও...

মাঝেমধ্যে যখন বলিউডের পুরোনো সিনেমাগুলো রিভিজিট করি অদ্ভুত আক্ষেপ হয়৷ এই সেদিন দেখলাম 'পিকু।' বাবা-মেয়ের সম্পর্ক, রোড ট্রিপ, কলকাতা, অমিতাভ-দীপিকা-ইরফানের দুর্দান্ত রসায়ন... এরকম 'ফিল গুড' সিনেমা তো খোদ হলিউডেও বিরল! অথচ, এরকম আরেকটা 'পিকু' আবার কবে তৈরী করবে বলিউড, প্রশ্ন সেখানে। ইমতিয়াজ আলীর 'জাব উই মেট' দেখলাম হুট করে। কালজয়ী 'বিফোর সানরাইজ' এর সেই ইন্ট্রোর মতই, ট্রেনের কামরায় দেখা দু'জনের। সেখান থেকে কতকিছু। হালকা চটকদার সব দৃশ্য, অথচ তার ভেতরেও গূঢ় সব বার্তা... ভাবি, আর অবাক হই৷ আরেকটা 'জাব উই মেট' বা, আরেকটা 'বীর জারা' অথবা 'লাইফ ইন অ্যা মেট্রো'র মত পেলব নির্মাণ কি আর আসবে বলিউডে? এলেও কবে আসবে? প্রযুক্তির ঝনঝনানি আর সেক্স-থ্রিল-ভায়োলেন্সের রাংতায় মোড়া সিনেমায় মশলামুড়ির স্বাদ তো পাচ্ছি। কিন্তু, ভেতরে বহুক্ষণ সজাগ থাকে যে নির্মাণ, সে নির্মাণ আজ কোথায়?

জানি, অতীত ঘেঁটে লাভ নেই। জীবনানন্দ দাশ বলেই গিয়েছিলেন- কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে! তবুও, অতীতের 'যন্তরমন্তর ঘর' এ ঘুরতে ঘুরতে আচমকাই মনে আসে যশ চোপড়া'র নাম। যে মানুষটি 'প্রেম' নামের অ্যাবস্ট্রাক্ট এই বিষয়টিকে করেছিলেন কালারফুল, লার্জার দ্যান লাইফ, সিনেম্যাটিক। 'প্রেম' এর তো আদতে কোনো সংজ্ঞা নেই। হয় না৷ সেজন্যেই হয়তো, যশ চোপড়ার সিনেমায় 'প্রেম' এর জন্যে ভারত-পাকিস্তানও এক হয়েছে, বরফে ঢাকা পাহাড়ের সামনে রোমান্সও হয়েছে, টিউলিপের বাগানে নায়ক-নায়িকার প্রেম-বিনিময়ও হয়েছে। এই নির্মাতার সিনেমায় ক্যারেক্টারগুলোর 'ডেভেলপমেন্ট' হয়তো সেভাবে ছিলোনা, নায়ক-নায়িকার ক্যারেক্টার আর্কও হয়তো সেভাবে স্টাবলিশ হতো না, কিন্তু, পাশাপাশি এও ঠিক, 'ওল্ড স্কুল রোমান্স' এর যে শুভ্রতা ও স্নিগ্ধতা, তা 'যশ চোপড়া'র মত এত নিখুঁতভাবে কেউ বুঝতোও না! 

টিউলিপের বাগানে প্রথম প্রেমের উচ্ছ্বাস 

তার নির্মাণের চরিত্রেরা প্রেমের জন্যে যেতে পারতো বহুদূরে। করতে পারতো বহুকিছু। ভালোবাসার মানুষের জন্যে যুগের পর যুগ অপেক্ষা, বন্ধুত্ব থেকে আচমকাই প্রেম, প্রেমকে বাঁচিয়ে রাখতে আত্মোৎসর্গ, প্রথম প্রেমের প্রজাপতির নাচন, শিফন শাড়ি আর রঙবেরঙ এর কুর্তায় কাশ্মীর থেকে সুইজারল্যান্ড...  'রোমান্স' নিয়ে আমাদের যে ফ্যান্টাসি, তার পুরোটুকুই যেন পর্দায় নিয়ে আসতেন যশ শর্মা। যে কারণেই, তার সিনেমার মূল চরিত্রদের ডিটেইলড পোর্ট্রেয়াল না থাকলেও, শুধুমাত্র এই দুর্দান্ত 'প্রেজেন্টেশন অব রোমান্স' এর কারণেই, চরিত্রগুলো অমর হয়ে গেঁথেছে আমাদের মনে। কী স্টোরি, ব্যাকগ্রাউন্ড, কি গান, কি লিরিক্স... সবখানেই যশ চোপড়া এমনভাবে এক্সিকিউট করেছেন সব, মুগ্ধ হওয়া ছাড়া বলার আর কিছু থাকেওনি। হোক দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে, সাথিয়া, দিল তো পাগল হ্যায়, বীর জারা, জাব তাক হ্যায় জান... হোক নির্মাতা শাদ আলী কিংবা আদিত্য চোপড়া... এই নির্মাতাদের 'রোমান্স' নিয়ে বাড়াবাড়ি করার সাহসটুকু যে তিনিই দিয়েছিলেন, তাও বা উপেক্ষা করি কিভাবে? 

'বীর-জারা'র সেই অদ্ভুত প্রণয়-আখ্যান এখনও হৃদয়ে সজাগ 

এখানে, আলাদাভাবে উল্লেখ্য, যদিও যশ চোপড়া প্রেম নিয়েই করেছেন সবকিছু, তবুও যশ চোপড়ার সিনেমার 'প্রেম'গুলোও একই সমীকরণে থাকেনি কখনো। লেখার শুরুতেই 'বিফোর সানরাইজ' এর কথা বলেছিলাম। সে সিনেমাতেই যেমন সম্পূর্ণ দুই অপরিচিত মানুষ জীবনের গাঁটছড়া বেঁধে ফেলে অজান্তে, তেমনটা আমরা যশ চোপড়ার প্রোডিউস করা সিনেমাতেও পেয়েছি। 'বান্টি অওর বাবলি', 'সালাম নমস্তে' কিংবা 'ফানা' সিনেমাতে। যেখানে অজানা দুইজন মানুষ, আচমকাই আটকে পড়ে ভালোবাসার মায়াজালে। যেখান থেকে আর ওঠা হয়না তাদের। ডুবে যাওয়াই হয় নিয়তি। আবার, সেই একই যশ চোপড়া যখন 'রাব নে বানা দি জোড়ি'র প্রযোজক হয়েছেন, সেখানে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজের মধ্যেও এসেছে ভালোবাসার সুলুকসন্ধান। আবার, 'মেরে ইয়ার কি দোস্তি হ্যায়' অথবা 'মুজসে দোস্তি করোগি'তে বন্ধুত্বই ক্রমশ রূপান্তরিত হয় প্রেমে। ভালোবাসায়। বলাই বাহুল্য, এসব সিনেমারও পেছনের মানুষ তিনি। অন্তরালের কলকাঠি নড়াচড়ার মূল হর্তাকর্তাও তিনি। 

অর্থাৎ, প্রমাণিত এটাই, যশ চোপড়া প্রেমের গল্পেও ক্রমাগত ভেঙ্গেছেন ন্যারেটিভ। চালিয়েছেন নিরীক্ষা। তাঁর নির্মাণ 'চাঁদনী' কিংবা পুত্র আদিত্য চোপড়ার নির্মাণ 'মোহাব্বাতিন' এ শ্রীদেবী অথবা ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চনের শিফন শাড়ির ওড়াউড়ি দেখে নাইন্টিজ কিড'দের ইতস্তত যে আক্ষেপ, সে আক্ষেপ উসকানোর পাশাপাশি 'যশ চোপড়া'র সিনেমায় এসেছে রিয়েলিটির ন্যারেটিভও। 'লামহে' সিনেমায় এক যুবতী কিভাবে তার দ্বিগুণ বয়সের এক মানুষের প্রেমে পড়ছে, সেটার মাধ্যমে যশ চোপড়া সোশ্যাল এক ট্যাবুকে কটাক্ষ করেছিলেন সরাসরিই। পাশাপাশি, 'প্রেমে পড়ার যে কোনো বয়স নেই, নেই কোনো সমীকরণ' প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সেটিকেও। আবার, 'সিলসিলা'য় কথা বলেছিলেন এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার নিয়েও। যখন মুক্তি পেয়েছিলো, তখন এসব সিনেমা নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। কিন্তু, এখন যত সময় গড়াচ্ছে, ততই বোঝা যাচ্ছে- সিনেমাগুলো কতটা এগিয়ে ছিলো সময়ের চেয়ে। বাকি সবার চেয়ে। 

ভালোবাসায় লীন দু'জন

কিছু মানুষ এমন থাকে, যারা হয়তো সবমিলিয়ে গ্রেট, কিন্তু তবুও তাদের থাকে এমন কিছু শক্তির জায়গা, যেখানে তারা রূপান্তরিত হন 'অমর শিল্পী'তে। এমন কিছু বৈশিষ্ট্য তাদের থাকে, যে বৈশিষ্ট্যে তারা ছাড়িয়ে যান আগে-পরের সবাইকেই। বাইসাইকেল কিকে 'পেলে'র মত কেউ যেমন নেই, কাভার ড্রাইভে 'টেন্ডুলকার'ই যেমন সর্বেসর্বা, সাসপেন্স ফিল্মে 'হিচকক' যেমন একমেবাদ্বিতীয়ম, তেমনি ছিলেন যশ চোপড়াও। পর্দার ক্যানভাসে 'প্রেম'কে এত রঙের বুনোটে তাঁর মত আঁকতে পারেনি কেউই। 'প্রেম'কে এতভাবে বিশ্লেষণও করতে পারেনি কেউ। আর সে কারণেই, 'প্রেমের সিনেমা' বলতে এখনও যশ চোপড়াই হয়ে আছেন শেষ কথা। যার আগে কেউ নেই। সামনে কেউ কোনোদিন আসবে কি না, অনিশ্চিত সেটাও। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা