বলিউডি নির্মাতারা কেন তাদের নির্মাণে নারীচরিত্র'কে প্রোটাগনিস্ট বানানোর ঝুঁকি নিতে চান না, এটা বেশ চিন্তাউদ্রেগকারী এক প্রশ্ন। তবে সে প্রশ্ন বোধহয় আজকাল ফিকে হতেও শুরু করেছে অনেকটাই। আজকাল সিনেমাতে লিড ক্যারেক্টার হিসেবে নারীদের ক্রমশই পাওয়া যাচ্ছে। এবং তারা মনে রাখার মতো কাজই উপহার দিচ্ছেন...

মেইনস্ট্রিম কমার্শিয়াল সিনেমা মানেই আমরা বরাবর ধরে নিই, সেখানে প্রোটাগনিস্ট থাকবেন পুরুষ কেউ। প্রচণ্ড পুরুষালি ব্যাপারস্যাপার তিনি দেখাবেন পর্দায়। নারীচরিত্র যদি কেউ থাকে, তাকে রাখা হবে 'শো-পিস' হিসেবে। আর্টফিল্মে মাঝেসাঝে নারীচরিত্রকে গুরুত্ব দেয়া হলেও, সেরকম আর্টফিল্মের সংখ্যাও কম। সুতরাং তাই এটা বলাই যায়, সিনেমা-সিরিজে নারীদের উপস্থিতি অনেকটাই গৌণ। বিষয়টা বিস্তর ভাবনার। নির্মাতারা কেন নারীচরিত্র'কে প্রোটাগনিস্ট বানানোর ঝুঁকি নিতে চান না, এটা বেশ চিন্তাউদ্রেগকারী এক প্রশ্নও। তবে সে প্রশ্ন বোধহয় আজকাল ফিকে হতে শুরু করেছে অনেকটাই। আজকাল সিনেমাতে লিড ক্যারেক্টার হিসেবে নারীদের ক্রমশই পাওয়া যাচ্ছে। এবং তারা মনে রাখার মত কাজই উপহার দিচ্ছেন। বলিউডেই যেমন এই এক বছরে দশটি এমন নির্মাণ হয়েছে, যেখানে নারীরা ছিলেন ড্রাইভিং সিটে। সিনেমাগুলোও হয়েছে জনপ্রিয়। কুড়িয়েছে সুনাম৷ সেসব সিনেমা নিয়েই আজকের কথাবার্তা। 

১. শেরনি

বিদ্যা বালানের সিনেমায় তিনি প্রোটাগনিস্ট হবেন এবং দারুণ অভিনয় করবেন... এ ন্যারেটিভ বহু আগেই সেট হয়ে গিয়েছে। কাহানি, দ্য ডার্টি পিকচার কিংবা শেরনি... বিদ্যা বরাবরই অনবদ্য। 'শেরনি'তেও যেমন সৎ এক ফরেস্ট অফিসার হয়ে তিনি লড়াই করলেন স্থানীয় রাজনীতি, দুর্নীতিগ্রস্থ প্রশাসন ও নিরক্ষর গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে। প্রোটাগনিস্ট হয়েও খুব জৌলুশহীন এক চরিত্রে দুর্দান্ত এক অভিনয়ই করলেন! 

শেরনি! 

২. মিমি

'মিমি' সিনেমা নিয়ে এ বছর বেশ ভালোই আগ্রহ ছিলো সবার। নামভূমিকায় কৃতী শ্যাননও হতাশ করেননি। সিনেমার জন্যে ওজন বাড়িয়েছেন৷ অভিনয়েও যত্ন নিয়েছেন৷ এ সিনেমার আগে কৃতীর সেরকম দুর্দান্ত অভিনয়ের কোনো উদাহরণ না থাকলেও, এই সিনেমা তাকে 'দক্ষ অভিনেত্রী'র খেতাবটিই দিয়েছে৷ উচ্ছ্বল এক তরুণী থেকে মমতাময়ী মা...সিনেমায় 'মিমি' চরিত্রটির ট্রান্সফরমেশনও ছিলো অনবদ্য! 

মিমি!

৩. পাগলাইত 

বেশ কিছুদিন আগেই সানিয়া মালহোত্রার 'মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর' দেখলাম। সানিয়া মালহোত্রা বেশ অল্পসময়েই নিজের অভিনয়ের স্বকীয় এক ধারা তৈরী করে নিয়েছেন, যা দর্শকের কাছে বেশ প্রশংসনীয়ও হচ্ছে। 'পাগলাইত' এ যেমন আমরা তাকে দেখি বিধবা এক নারীর চরিত্রে, যে স্বামীহারানো শোকে ভেঙ্গে না গিয়ে বরং জীবনের মানে খুঁজে পেতে চাইছে। এ সিনেমার মূলভাব এমন, তা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অনেকের কাছেই ঠিক গ্রহনযোগ্য হবে না। কিন্তু এ সিনেমার মূলভাবই যে সিনেমাকে পৌঁছে দিয়েছে অন্য দ্যোতনায়, অস্বীকার করা যাবে না সেটিও। 

পাগলাইত! 

৪. হাসিন দিলরুবা

'হাসিন দিলরুবা'র প্রথমাংশে তাপসী পান্নুর অভিনয় 'বলিউডি শো-পিস' রকমের হলেও সিনেমা যতই সামনে এগিয়েছে, ক্রমশই তাপসী অভিনয়ের মোড় খুলেছেন। সিনেমা যতই পরিণতির দিকে গিয়েছে, আমরা টের পেয়েছি ভিক্রান্তের পাশাপাশি তাপসীও সমানতালে অভিনয় করছেন। এবং সিনেমার শেষাংশে গিয়ে পুরোটাই তো 'ওয়ান ওম্যান শো।' এ সিনেমা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে অনেকেরই। তবে তাপসী'র অভিনয়ের জন্যে হলেও এ সিনেমা একবার দেখাই যায়! 

হাসিন দিলরুবা

৫. আজিব দস্তানস

চার গল্পের অ্যান্থোলজি 'আজিব দস্তানস' এর এক গল্প বেশ দুর্দান্ত ছিলো। 'গিলি পুচি' শিরোনামের সে গল্পে কঙ্কনা সেন শর্মা ও  অদিতি রাও হায়দারির মধ্যবর্তী মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেসব সামাজিক ব্যাধিকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন নির্মাতা, দুর্দান্ত। কঙ্কনা সেন শর্মা এমনিতেও দুর্দান্ত অভিনেত্রী। কিন্তু এ সিনেমায় অল্পসময়ের জন্যে এলেও যে অনবদ্য অভিনয় তিনি করলেন, তা চোখে লেগে থাকার মতন। পাশাপাশি অদিতি রাও হায়দারিও যোগ্য সমর্থন দিয়ে গিয়েছেন তাকে! 

গিলি পুচি

৬. রামপ্রসাদ কি তেহরভি 

ছিমছাম এক গল্প, অনসম্বল কাস্ট, দারুণ স্ক্রিনপ্লে... রামপ্রসাদ কি তেহরভি সিনেমায় নানারকম উপাচার একত্রিত হয়ে যে মিশ্রন তৈরী হয়েছে, তা গল্পকেই যেন খোলতাই করেছে পুরোপুরি। অনেক কুশীলবের মিলনমেলা হলেও আলাদা করে সুপ্রিয়া পাঠকের চরিত্রটাই মনে ধরেছিলো। প্রিয়জন-হারানো বিষাদগ্রস্ত, বিভ্রান্ত চরিত্রে যে অভিনয় তিনি করেছেন, তা হৃদয়ে দাগ কেটেছে অনেকেরই।

রামপ্রসাদ কি তেহরভি! 

৭. রেশমি রকেট

তাপসী পান্নুর সাম্প্রতিক সিনেমাগুলোতে একটা বিষয় খুব প্রকটভাবে দৃশ্যমান; সিনেমাগুলো নিয়ে দর্শকমহলে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা। থাপ্পড়, হাসিন দিলরুবা কিংবা রেশমি রকেট... একদিকে যেমন দর্শক এই সিনেমাগুলোতে তাপসীর চরিত্রের প্রশংসা করেছেন, অন্য দিকে কিছু দর্শক বিস্তর কটু বাক্যবাণেও মগ্ন হয়েছেন। তবে যেটিই হোক না কেন, তাপসী যে এসবে খুব একটা গা করেন না, সেটিরই প্রমাণ একের পর এক সাহসী চরিত্রে অভিনয়। যার নবতম উদাহরণ- রেশমি রকেট! 

রেশমি রকেট! 

৮. থ্যালাইভি 

যদিও কঙ্কনা রানাউত প্রশ্নবিদ্ধ কাজেই অধিকাংশ সময় নিয়োজিত রাখেন নিজেকে, অভিনয়কে মূখ্য না রেখে বহুবিধ অযথা পণ্ডশ্রম করে বিস্তর গালমন্দ কুড়োতে থাকেন মানুষের, তবুও অভিনয় যখন করেন, বেশ মন দিয়েই করেন। এই যেমন- 'থ্যালাইভি'তে জয়ললিতা চরিত্রে দারুণ অভিনয় করলেন। তিনি যদি শুধুমাত্র অভিনয়তেই মনোযোগ দিতেন, তাহলে আরো দুর্দান্ত নির্মাণের সাথেই যুক্ত হতে পারতেন। অবশ্য যা হয়নি, তা নিয়ে বলেও বা কী হবে? 

থ্যালাইভি! 

৯. নভেম্বর স্টোরি

তামিল এই ক্রাইম থ্রিলার যদিও খুব আশা জাগিয়ে শুরু করে শেষদিকে এসে অনেকটাই খেই হারিয়েছিলো, তবুও এই নির্মাণে অনবদ্য অভিনয়ের জন্যে আলাদা করে প্রোটাগনিস্ট তামান্না ভাটিয়ার প্রশংসা করতেই হয়। 'লাস্যময়ী নায়িকা' তকমা থেকে বের হয়ে জীবনযুদ্ধে নিয়োজিত এক সাহসী তরুণীর চরিত্র যেরকম অভিনয় প্রত্যাশা করে, সেরকমটাই করেছেন তিনি। যারা পুরো সিরিজ দেখেছেন, তারা এ কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করবেন, বলতে গেলে তামান্না একাই টেনে নিয়েছেন পুরো সিরিজকে। 

নভেম্বর স্টোরি! 

১০. মহারানী

হুমা কুরেশীর এই ওয়েব সিরিজ নিয়ে খুব কম মানুষই জানে। বিহারের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন নিয়ে নির্মিত এ ওয়েব সিরিজে 'রানী ভারতী' চরিত্রে যে অভিনয় হুমা কুরেশীর, তা দারুণ। যদিও মূল টিভি সিরিজের গল্পবিন্যাসে বিস্তর খামতি ছিলো। তবে সেটুকু বাদ দিয়েও শুধুমাত্র হুমা কুরেশীর অনবদ্য অভিনয় দেখার জন্যে হলেও 'মহারানী' রেকোমেন্ডেড। 

মহারানী! 

যদিও সৃজনশীলতায় নারী-পুরুষ বিভেদ করা আসলে সংকীর্ণতারই সামিল। তবুও আমাদের আশেপাশের ইন্ডাস্ট্রিতে এই বিষয়টিরই নগ্নরূপ দেখেছি বহুদিন। স্থানাঙ্ক যে পাল্টাচ্ছে, আবার সেটিরও প্রমাণ পাচ্ছি ইদানীং। আশা রাখি, প্রোটাগনিস্ট হিসেবে নারী চরিত্রের উপস্থিতি নিয়মিতই দেখবো সর্বত্র। তাহলেই ভাঙ্গবে বহুদিনের অসুস্থ সংস্কার। সাধিত হবে কল্যান। সেজন্যেই হাপিত্যেশ। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা