বব বিশ্বাস: অভিষেকে সন্তুষ্টি, গল্পে ক্ষোভ!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
থ্রিলার সিনেমা এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেখানে দাঁড়িয়ে 'বব বিশ্বাস' মনে রাখার মত কোনো নির্মাণ না। গল্প, গল্প বলার ধরণ, ক্যামেরার কাজ কিংবা সিনেম্যাটোগ্রাফি- কোনো জায়গাতেই নির্মাতা দিয়া অন্নপূর্ণা ঘোষ এমন কোনো অভিনব বিষয় দেখাতে পারেন নি, যা নিয়ে আলাদা করে কথা বলা যায়। একমাত্র ভালো দিক, 'বব বিশ্বাস'রূপী অভিষেক বচ্চনের অভিনয়। বাকিসব গড়পড়তা। অভিনবত্ব নেই মোটেও...
দুই ঘন্টা দুই মিনিটের এক সিনেমা। সেই সিনেমায় আট মিনিটের এক চরিত্রের অভিনয় কতটুকু গভীর দাগ ফেলতে পারে দর্শক-মনে? আট-দশ মিনিটের এক পার্শ্বচরিত্র ঠিক কতটা ঝাঁকুনি দিতে পারলে তাকে নিয়ে আলাদা এক সিনেমা হতে পারে? এসব প্রশ্ন মাথায় আসবে না, যদি কেউ সুজয় ঘোষের 'কাহানি'তে 'বব বিশ্বাস'রূপী শাশ্বত চ্যাটার্জীর অভিনয় দেখে থাকেন। অজ্ঞাতকুলশীল এক পরিপাটি ভদ্রলোক, ইন্সুরেন্স কোম্পানির পাশাপাশি করেন সিরিয়াল কিলিং, কাউকে খুন করার আগে বলেন 'নমস্কার, আমি বব বিশ্বাস', সেই চরিত্র স্বকীয়তা ও বৈচিত্র্যের গুণে এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো, এই চরিত্রকে নিয়ে যখন স্পিন-অফের ঘোষণা এলো, নড়েচড়ে বসাটাই ছিলো প্রাসঙ্গিক।
যদিও প্রাথমিক এ উচ্ছ্বাসের আগুনে জল ঢেলে দেয় 'বব বিশ্বাস' চরিত্রে শাশ্বত চ্যাটার্জীর অনুপস্থিতির সংবাদ। যে শিল্পী আপাদমস্তক তুখোড় অভিনয় করে কল্পিত এই চরিত্রকে জনপ্রিয় করলো গোটা উপমহাদেশেই, তাকে 'ব্রাত্য' করার এ বিষয়টি ভালো লাগলো না। জানা গেলো, 'বব বিশ্বাস' চরিত্রে অভিনয় করবেন অভিষেক বচ্চন। এরই মাঝে 'বব বিশ্বাস' এর শুটিং স্পট থেকে আলগোছে বেরিয়ে আসা 'বব বিশ্বাস'রূপী অভিষেক বচ্চনকে দেখে আবার সিনেমা নিয়ে আশাবাদী হতে হলো। ট্রেলারেও কাহিনীর স্রোতপ্রবাহ খারাপ লাগলো না। কিন্তু সিনেমার শেষে এসে মনে হলো, শেষমেশ দূর্বল গল্পই যেন জল ঢেলে দিলো নির্মাণে!
জানা যায়, জোব চার্নকের কলকাতায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা সম্প্রতি এক বিশেষ নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। 'ব্লু' নামের এক মাদক নিয়মিত গ্রহণ করছে তারা। আন্ডারওয়ার্ল্ডের একটা দল খুব সক্রিয়ভাবেই চালাচ্ছে 'ব্লু'র এই ব্যবসা। ক্রমশই শহরে ছড়িয়ে পড়ছে বিষাক্ত এই মাদক। এই মাদকের জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে যুবসমাজও। এরকম এক সময়েই বব বিশ্বাস আট বছরের পুরোনো কোমা থেকে জেগে উঠেছেন। তবে তিনি জাগলেও তার স্মৃতি জাগেনি মোটেও। স্মৃতিহীন ফাঁকা মস্তিষ্কে ক্রমশ তিনি আবিষ্কার করছেন, তার স্ত্রী আছে, দুই সন্তান আছে। ইন্সুরেন্স কোম্পানির চাকরি আছে। বব বিশ্বাসের এসব ঘটনার সাথে অভ্যস্ত হতে সময় লাগলেও সে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
যদিও বিগত অতীতের সবকিছু বব বিশ্বাস ভুলে গিয়েছেন, কিন্তু তার পুরোনো সহচরেরা তাকে ভোলেনি মোটেও। সে কারণেই বিস্মৃতপ্রায় অতীত নিয়ে যুঝতে থাকা বব বিশ্বাসকে তারা ক্রমশই আবার যুক্ত করে নিচ্ছে পুরোনো সেই পেশার সাথে। কন্ট্রাক্ট কিলিং এর সাথে। স্ফীত উদর, চোখে বড় ফ্রেমের চশমা, অদ্ভুত সিঁথির চুল, উদাস দৃষ্টি, পরিপাটি জামাকাপড় এবং সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল...বব আবার ঢুকে পড়ছেন রক্ত-বুলেট-লাশের পৃথিবীতে। ববের এই সিরিয়াল কিলিং এর শাখা-প্রশাখায় আস্তে আস্তে যুক্ত হচ্ছে ব্লু, স্ত্রী, কন্যা, পুত্র, কালী দা সহ আরো অনেকে। এরপর কিছু সংকট আসবে। অ্যাকশন আসবে। এই পর্যন্তই। মোটা দাগে এটুকুই গল্প।
প্রথমত 'বব বিশ্বাস' এর গল্প খুবই সাদাসিধে। কোনো জটিলতা গল্পের কোনো পর্যায়েই নেই। বরং প্রথম দিকে সামান্য যা জট ছিলো, শেষদিকে এসে তাও নেই। দূর্বল গল্প, খেলো ক্ল্যাইম্যাক্স, চরিত্রগুলোর সাথে ইনজাস্টিস...এভাবেই এগিয়েছে সব। এবং সবচেয়ে যা দৃশ্যকটু, গল্পের গভীরে যাওয়ার কোনো চেষ্টাই করেনি নির্মাতা। এরকম এক ডার্ক শেডের ক্যারেক্টার 'বব বিশ্বাস', তার জীবনকে যেভাবে বিল্ডআপ করা হলো সিনেমায়, তাতে না রয়েছে স্বকীয়তা, না চমক!
এ সিনেমায় যদি একমাত্র ভালো কোনো বিষয় থাকে, তা অভিষেক বচ্চন। এই অভিনেতা বরাবরই ভালো অভিনয় করেন, কিন্তু কোনো এক বিশেষ কারণে সে বরাবরই আন্ডাররেটেড। বাবার প্রখর ক্যারিয়ারের সাথে তুলনার কারণেই হোক কিংবা বাজে স্ক্রিপ্ট সিলেকশন... অভিষেক বচ্চনের প্রতিভা অনুযায়ী সেরকম মূল্যায়ন হয়নি কখনোই। 'বব বিশ্বাস' দেখার পরে এই আক্ষেপ আরো জোরদার হয়েছে। অ্যামনেশিয়ার এক রোগী, যিনি সব ভুলে বসে আছেন, পদে পদে যিনি বিভ্রান্ত হচ্ছেন যাপিত নানা বিষয় নিয়ে, সেই মানুষটিই যখন আবার হাতে পিস্তল তুলে নিচ্ছেন, চেহারায় এক ধারালো ভাব ফুটে উঠছে...চরিত্রের এই বিপরীতমুখী দ্বৈতসত্তা যেভাবে ফুটিয়ে তুললেন অভিষেক, তা অনবদ্য। পুরো সিনেমাতেই চেহারায় যে এক নিষ্পাপ ভাব ধরে রাখলেন তিনি, সেটাও বিস্তর ইতিবাচক। যদিও শাশ্বতের সাথে তুলনা হলে খানিকটা ম্লান হবেন তিনি। তবুও তুলনা না করেই বলা যায়, খুবই স্বকীয় এবং ধারালো অভিনয় করেছেন।
পাশাপাশি, 'কালী দা'রূপী পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর প্রশংসাও করতে হবে। এই মানুষটিও গুণী শিল্পী। কিন্তু ক্যারিয়ারের অনেকটা সময়েই ভাঁড়ামোর কিংবা খুবই নগন্য চরিত্রে অভিনয় করতে দেখেছি তাকে। এই সিনেমার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী এক চরিত্র পেয়ে দারুণ অভিনয়ই করলেন! বাদবাকিরা তথৈবচ। মনে রাখার মত কেউ না। চিত্রাঙ্গদা, রজতাভ কিংবা অমর...কাউকেই সেভাবে ব্যবহার করা হলো না। সিনেম্যাটোগ্রাফী কিংবা বিজিএম অথবা গান...কোনোখানেই গড়পড়তার আবহের বাইরে স্বকীয় কিছু পেলাম না। উচ্ছ্বসিত হবার মত কোনো অনুষঙ্গ পেলাম না!
থ্রিলার সিনেমা এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেখানে দাঁড়িয়ে এ সিনেমা মনে রাখার মত কোনো নির্মাণ না। গল্প, গল্প বলার ধরণ, ক্যামেরার কাজ কিংবা সিনেম্যাটোগ্রাফী... কোনো খানেই নির্মাতা দিয়া অন্নপূর্ণা ঘোষ এমন কোনো অভিনব বিষয় দেখাতে পারেন নি, যা নিয়ে আলাদা করে কথা বলা যায়। একমাত্র ভালো দিক, বব বিশ্বাসের অভিনয়। সেটুকুর জন্যে এবং মোটামুটি গোছের থ্রিলার সিনেমা তাও আবার কলকাতার প্রেক্ষাপটে, তা দেখতে চাইলে, 'বব বিশ্বাস' দেখা যেতে পারে। এছাড়া এ সিনেমা দেখার আর বিশেষ কোনো কারণ নেই বলেই বিশ্বাস। যেহেতু দিয়া অন্নপূর্ণা ঘোষের এটি প্রথম নির্মাণ, তাই অতটা খড়্গহস্ত হওয়াটাও সমীচীন না। আশা করি বাবা সুজয় ঘোষের উত্তরাধিকার হিসেবে চমকে যাওয়ার মত নির্মাণ নিয়ে তিনি পরবর্তীতে আসবেন। সেজন্যে শুভকামনা রইলো।