বইকে উপজীব্য করে যে আয়োজন 'বঙ্গ'র, সে আয়োজনে এবারে দূর্বল কাজ এসেছে, এটা ঠিক। তবে এও ঠিক, পাশাপাশি কিছু নতুনত্বও এসেছে। গল্পবয়ানেও বেশ অন্যরকম কিছু ট্রিটমেন্ট পেয়েছি। সেসব চিন্তাভাবনায়, তুলনামূলক বিশ্লেষণে তাই 'বঙ্গ বব' দ্বিতীয় সিজনকে খুব একটা উপেক্ষা করাও যাচ্ছে না। কিন্তু...

সাহিত্য ও সিনেমাকে কিছু মানুষ প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেন। এই মানুষেরা এই দুই মাধ্যমকে ঘিরে ভিন্ন শিবিরেও অবস্থান নেন। 'কে শ্রেষ্ঠ' এ প্রশ্নে মুখোমুখি লড়াইও চলে বিস্তর। অথচ, সাহিত্য ও সিনেমা মোটেও যে প্রতিদ্বন্দ্বী না, তাদের সম্পর্ক যে অতল গভীর, তার স্বপক্ষেও উদাহরণ আছে ঢের। 'পথের পাঁচালী' থেকে 'টু কিল আ মকিংবার্ড', ' দ্য গডফাদার' থেকে 'এ বয় ইন দ্য স্ট্রাইপড পাজামাস'... সাহিত্যাশ্রয়ী এই নির্মাণগুলোই সাক্ষী, বই থেকে সিনেমা হলে, সেটা কতটা অসাধারণ হয়! এবং হয়তো সে বিবেচনাতেই, যখন স্ট্রিমিং সাইট 'বঙ্গ' গত বছর ঘোষণা দিয়েছিল, তারা সাতটি বই থেকে সাতটি টেলিফিকশন বানাবে, সত্যি বলতে, বেশ মুগ্ধই হয়েছিলাম। এবং বেশ আগ্রহ নিয়েই দেখেছিলাম কাজগুলো। শাহাদুজ্জামান, শিবব্রত বর্মণ সহ বেশকিছু লেখকের গল্পাশ্রয়ী নির্মাণ বেশ মনেও ধরেছিলো।

এরকম যে বহু মানুষেরই মনে ধরেছিলো, সেটারই প্রমাণ, 'বঙ্গ'র আবার 'বেইজড অন বুকস' প্রজেক্ট ফিরিয়ে আনা। যদিও এবারের লেখকদের লাইনআপ দেখে বোঝাই  যাচ্ছিলো- সামাজিক মাধ্যমের জনপ্রিয় লেখকদেরই বাছা হয়েছে এবার। তবে আশা এটাই ছিলো, এই লেখকেরাও যেহেতু দারুণ গল্প লেখেন, এবারের প্রজেক্টও হয়তো গতবারের মতই দারুণ হবে। এবং, আক্ষেপের বিষয়, ঠিক এখানে এসেই খানিকটা হতাশ হতে হয়েছে। প্রতিটি গল্পেরই দারুণ হওয়ার সুযোগ ছিলো বিস্তর। তবে, শেষপর্যন্ত সে সুযোগের সদ্ব্যবহার কেন হয়নি, তা নিয়ে ক্রমশ ভাবনাচিন্তা করতেও ইচ্ছে হয়েছে।

যেমন, এই সিজনের প্রথম গল্প, অর্থাৎ, এক 'অলৌকিক বিকেলের গল্প' দিয়ে যদি শুরু করি- মূল গল্পটা খুব যে আহামরি ছিলো, এমন না। যাত্রাপথে দুই নারী-পুরুষের দেখা হচ্ছে। তাদের মাঝেই আচমকা চলে আসছে এক অদ্ভুতুড়ে চরিত্র, তারা মিলে নানারকম সিচুয়েশন তৈরী করছে, এ নিয়েই গল্প। খুবই ফ্লাট টোনের গল্প। কিন্তু, তার চেয়েও ফ্লাট, গল্প বয়ান। চাইলেই কিন্তু এ গল্পকে খোলনলচে পালটে খানিকটা জাঁকালো করা যেতো। যেটা করা হয়নি। এবং, মূলত, সেটাই হলো আক্ষেপ। 

এ টেলিফিকশনটা না জমলেও এই সিরিজের দ্বিতীয় নির্মাণ 'প্রায়শ্চিত্ত' আবার বেশ ভালোভাবেই জমেছে। ওবায়েদ হকের গল্প, ভিকি জাহেদের নির্মাণ, আফরান নিশোর অভিনয়... সব ক্লিক করেছে একসাথে। এবং, তারই ফলশ্রুতিতে যে জিনিস দাঁড়িয়েছে, সেটা বেশ উপভোগ্যও লেগেছে। একজন তৃণমূল মানু্ষ আচমকা যেভাবে বিত্তশালী হলেন এবং যেভাবে অতীত তাকে নাকাল করতে লাগলো ক্রমশ, গল্প মূলত বোধের সে জায়গাটিতেই করেছে বাজিমাত।

'প্রায়শ্চিত্ত' বেশ ভালো লেগেছিলো

তৃতীয় গল্প, অর্থাৎ, 'ফ্রিল্যান্সার নাদিয়া' আহামরি গল্প না হলেও গল্পের ট্রিটমেন্ট ছিলো চমৎকার। যেভাবে গল্প এগিয়েছে, সম্পর্কের যাপিত টানাপোড়েন আর খুনসুটির লেয়ারে যেভাবে মেইন স্টোরিকে বিল্ডাপ করা হয়েছে, তা বেশ ভালো লেগেছিলো। এবং, বেশ ছিমছাম এক অর্থবহ আবহ বজায় ছিলো পুরো গল্পেই। শেষের খানিকটা মানবিক পরিনতি গল্পে খানিকটা অন্য দ্যোতনাও দিয়েছে। সবমিলিয়ে, সন্তুষ্টি ছিলো। 

এর পরের গল্প, আরেক কাঠি সরেস। সাদা প্রাইভেট। গল্পটা যেরকম গভীর জীবনবোধের, নির্মাণও হলো তেমন। কুশীলবেরা করলেনও খুব নিবিড় অভিনয়। ক্যামেরার কাজেও থাকলো চমৎকারিত্ব। সবমিলিয়ে, 'বঙ্গ বব' এর এই সিজনের সবচেয়ে ভালো নির্মাণ হিসেবে যদি কেউ এই নির্মাণকে আখ্যায়িত করতে চান, সেখানে দোষের কিছু বলাও যাবেনা। পুরো টেলিফিকশনেই বজায় রইলো অদ্ভুত এক সারল্য, মায়া। ভালো লাগলো।

মুগ্ধ করেছে 'সাদা প্রাইভেট' 

পঞ্চম গল্প, 'হাফ চান্স' জমতে পারতো, কিন্তু যতটা আশা করেছিলাম, ততটা জমেনি। মূল যে গল্প, সেটা আগেই পড়া ছিলো। জানতাম, এ গল্প নিয়ে টেলিফিকশন বানাতে গেলে নজর রাখতে হবে এক্সিকিউশনের ইউনিকনেসে। মূলত, সেখানেই খানিকটা খামতি হলো। সবমিলিয়ে নির্মাণটা উতরে গেলেও, তাই, আক্ষেপের জায়গা রইলো বেশ।

এ পর্যন্ত পড়ার পরে সচেতন পাঠকেরা একটা বিষয় হয়তো বুঝতে পেরেছেন, সিজনের একেবারে প্রথম গল্পেই হোঁচট খাওয়ার পরেও বাকি গল্পগুলোর বরাতে কিন্তু বেশ ভালোভাবেই উঠে দাঁড়িয়েছিলো 'বঙ্গ বব।' এবং, শেষপর্যন্ত এভাবেই যেতে পারলে, হয়তো তৃপ্তির ঢেঁকুরও উঠতো। কিন্তু, সেটা হয়নি শুধুমাত্র শেষ দুটি নির্মাণের কারণে। 'সুরভি' ও 'চল' নামের দুটি টেলিফিকশন, দুটিই হতাশ করেছে তীব্রভাবে। 'সুরভি'র গল্প যেরকমই হোক, সে গল্পের ট্রিটমেন্ট এতটা হতাশাজনক, ভালো লাগেনি। ডাবিং, এডিটিং, সাউন্ড মিক্সিং... সবকিছুতে এতটাই অপেশাদারিত্ব, দেখার আগ্রহই উবে গিয়েছিলো পুরোপুরি। 'চল'ও তথৈবচ। গল্প, এক্সিকিউশন কিংবা চরিত্রদের অভিনয়... কোনোখানেই কোনো সামঞ্জস্য নেই৷ লাউড অ্যাক্টিং আর খাপছাড়া স্ক্রিনপ্লে'তে এ নাটকের শেষটাও হয়েছে তাই বেশ হতাশাজনক। 

এই দুই নির্মাণ হতাশ করেছে বিস্তর

এবার যদি তুলনামূলক বিশ্লেষণে আসি, এবারের সিজনের সাতটি গল্পের মধ্যে চারটিই বেশ ভালো। অল্পবিস্তর 'যদি-কিন্তু'র আক্ষেপ সেসব গল্পেও আছে, তবে তা প্রধান করে দেখার মত বড় না। আবার, এই চারটি গল্প বিবেচনায়, বাকি যে ৩টি গল্প, তা আবার বেশ হতাশাজনক। তবে, সেজন্যে, পুরো সিজনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলার কোনো মানে নেই৷ বইকে উপজীব্য করে যে আয়োজন 'বঙ্গ'র, সে আয়োজনে এবারে দূর্বল কাজ এসেছে, এটা ঠিক। তবে এও ঠিক, পাশাপাশি কিছু নতুনত্বও এসেছে। গল্পবয়ানেও বেশ অন্যরকম কিছু ট্রিটমেন্ট পেয়েছি। সেসব চিন্তাভাবনায়, তুলনামূলক বিশ্লেষণে এটুকু তাই বলাই যায়- 'বঙ্গ বব' এবারের ভুলগুলোকে নিয়ে গভীর চুলচেরা বিশ্লেষণ করুক। ভুল থেকে শিখুক৷ নেক্সট সিজনে আরো শক্তভাবে ফিরে আসুক। প্রত্যাশা জারি রাখছি। বজায় রাখছি শুভকামনাও। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা