মানবিক এক গল্পের পাশাপাশি 'প্রায়শ্চিত্ত' নাটকে বেশ কিছু ন্যুয়ান্সও ছিলো। ধনী-গরীবের ক্লাস ডিফারেন্স, দুঃসময়ে কাছের মানুষের অপরিচিত আচরণ, অপরাধবোধের টানাপোড়েন আর মেন্টাল কনফ্লিক্ট- ক্রমশই এসেছে তারা। ছিমছাম মোড়কে উসকে দিয়েছে নানাবিধ প্রশ্নও। সেসব প্রশ্নই মূলত এ নির্মাণকে স্বকীয় করেছে। উপভোগ্য করেছে।

মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়। কারণে অকারণে বদলায়।

মুনীর চৌধুরীর 'কবর' নাটকের এ বিশেষ লাইন জানেন মোটামুটি অনেকেই। নির্জলা সত্যি এ লাইন বোঝায় এটাও- ধ্রুবক নয় কিছুই। সবই পালটায়। ক্ষণেক্ষণে পালটায়। অনুপম রায়ও যেমন গেয়েছেন- 

শোনো, অভ্যেস বলে কিছু হয়না এ পৃথিবীতে,
পালটে ফেলাই বেঁচে থাকা।

তেমনি, পালটায় সবাই-ই। অথবা, সবাই-ই পাল্টাতে চায়। কিন্তু সে পাল্টানোর প্রক্রিয়া কি সবসময়ে সুখকর হয়? বেড়ার ওপাশের ঘাস কি সবসময়েই সবুজ? মূদ্রার উল্টোপিঠে যে স্বস্তি থাকবে, এটা কি নিশ্চিত?

'প্রায়শ্চিত্ত'র টুকরো টুকরো ন্যুয়ান্সগুলোও মুগ্ধ করে

মূলত, এসব প্রশ্নই ক্রমশ জন্মায় 'প্রায়শ্চিত্ত' গল্পে। যে গল্প লিখেছেন ওবায়েদ হক। এবং, যে গল্প নিয়েই  'বঙ্গ বব' এর দ্বিতীয় সিজনের দ্বিতীয় নাটকের আবির্ভাব। ওবায়েদ হক সিদ্ধহস্ত লেখক,  এবং সে কারণেই, তার গল্প নিয়ে আশা ছিলো বিস্তর। এবং, যে  পরিচালক এই গল্পকে নাট্যরূপ দিচ্ছেন, অর্থাৎ, ভিকি জাহেদ, ভরসা ছিলো তার নির্মান-দক্ষতার উপরেও। জানতাম, গল্পকে ঠিকঠাকই ট্রিটমেন্ট করবেন তিনি। যেটা তিনি করেছেনও। গল্প কিংবা, গল্পবয়ান... এই দুই বিষয়ের মধ্যে বজায় ছিলো দারুণ সামঞ্জস্যও।

'প্রায়শ্চিত্ত' শুরু হয় কামরুলকে দিয়ে। 'কামরুল' এ নাটকের কেন্দ্রস্থল। যে কেন্দ্রস্থল অর্থের অভাবে বহুদিন ধরেই কাটাচ্ছে অবর্ণনীয় দুঃসহ সময়। কিন্তু যেহেতু কোনোকিছুই চিরস্থায়ী না। তেমনি করে, কামরুলের জীবনও পালটায়। অমানবিক দারিদ্র্যের  সাথে ওঠাবসা করতে করতে একদিন অপ্রত্যাশিত উপায়ে সে হয়ে যায় অঢেল অর্থবিত্তের মালিক। যদিও, বিত্তবান হওয়ার পরেও স্বস্তি আসেনা জীবনে। মানসিক দোটানা, অস্বস্তি, প্যারাডক্স... কামরুলের জীবনের যাপিত সংকটগুলো ক্রমশই তড়পায়, ক্ষণেক্ষণে আচ্ছন্ন করে তাকে।  এবং, ঠিক এভাবেই, কামরুলের অদ্ভতুড়ে ভাগ্যের নানা অলিগলি-পথে  এগোতে থাকে গল্প। গল্পে যদিও থাকে আরো কিছু চরিত্র, তবে, কামরুলের তুলনায় তাদের উপস্থিতি খুবই গৌণ। মূলত, নন লিনিয়ার স্টাইলে চলা গল্পের প্রধান এবং একমাত্র চরিত্র কামরুল নিজেই।

এটা ঠিক, 'প্রায়শ্চিত্ত'কে আহামরি গল্প বলা যাবেনা। কারণ, যে মোরাল গ্রাউন্ড ভেবে এ গল্প, এই মোরাল গ্রাউন্ডে পিচ করে বহু গল্প, সিনেমা বানানো হয়েছে। সেটা জানাও ছিলো। গল্প নিয়ে তাই সেরকম প্রত্যাশা ছিলোও না। প্রত্যাশা ছিলো গল্পবয়ান নিয়ে। ভিকি জাহেদের গল্প ন্যারেশন এমনিতেও বেশ ছিমছাম হয়। খানিকটা আন-অর্থোডক্সও হয়। সে হিসেবেই ধারণা ছিলো, এই গল্পের ন্যারেশনেও হয়তো খানিকটা চমকের উপাদান রাখবেন তিনি। রেখেছেনও। 'কামরুল' এর জীবনকে নানা টাইমফ্রেমে দেখিয়ে, দর্শকের আগ্রহ তিনি ভালোভাবেই ধরে রেখেছেন শেষতক। এবং, তার চিরাচরিত যে গল্পবয়ান, সেখান থেকেও যে খানিকটা সরে এসেছেন তিনি এ নির্মাণে, ইতিবাচক লেগেছে সেটাও। 

প্রোটাগনিস্ট 'কামরুল' চরিত্রে আফরান নিশোও বেশ দারুণ করেছেন। তার চরিত্রের শেড যখন যেরকম অভিনয় ডিমান্ড করেছে, পুরোটাই এসেছে তার থেকে। আহামরি অভিনয় করেছেন, এমনটা বলা যাচ্ছেনা। আহামরি অভিনয়ের সুযোগও ছিলো না। তবে গণ্ডির মধ্যে থেকে যতটুকু করা সম্ভব, ততটুকু ঠিকঠাক করেছেন। বিশেষ করে, ভাতের খিদে ঝালমুড়ি দিয়ে মেটানোর প্রবঞ্চনা কিংবা তীব্র গরমে দরদর করে ঘামা... এই দৃশ্যগুলোতে কনভিন্সিং অভিনয়ই করেছেন তিনি। ভালো লেগেছে। পাশাপাশি, নিশাত প্রিয়ম, ফারুক আহমেদও দারুণ। নিজ নিজ চরিত্রের ঠিকঠাক দায়িত্ব সামলেছেন তারাও।  

আফরান নিশো করলেন দুর্দান্ত অভিনয় 

মানবিক এক গল্পের পাশাপাশি 'প্রায়শ্চিত্ত' নাটকে বেশ কিছু ন্যুয়ান্সও ছিলো। ধনী-গরীবের ক্লাস ডিফারেন্স, দুঃসময়ে কাছের মানুষের অপরিচিত আচরণ, অপরাধবোধের টানাপোড়েন আর মেন্টাল কনফ্লিক্ট... ক্রমশই এসেছে তারা। ছিমছাম মোড়কে উসকে দিয়েছে নানাবিধ প্রশ্নও। কামরুল যেমন প্রশ্ন করেছে- 

নীলু, তুমি কি সুখী?

এ প্রশ্ন যেন বুকে বেঁধে আমাদেরও। আমরা কি সুখী? আমাদের যা আছে, তা কি আমাদের স্বস্তি দিচ্ছে? নাকি, আরো কিছু পেতে চাচ্ছি নিয়মিত? পাশাপাশি, অর্থের মোড়কে রাতারাতি যেভাবে পালটে যাচ্ছে সোশ্যাল স্ট্যাটাসের সাত-সতেরো,  ক্লাইম্যাক্সে যেভাবে এসেছে করুণ কিছু আখ্যান, এই নাটকের শেষে এসে তাই বড়সড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে আসে সে প্রশ্নটাও- 

যে প্রায়শ্চিত্ত করলেন কামরুল, তা কি যথাযথ হলো?

কিছু পাপের কি আসলেই প্রায়শ্চিত্ত হয়? প্রায়শ্চিত্ত হলেই কি পাপ কমে যায়? এসব গূঢ় প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্যে হলেও দেখা যেতে পারে 'প্রায়শ্চিত্ত।' আর কিছু না হোক, কিছু গভীর প্রশ্নের সাথে যে দেখা হয়ে যাবে দর্শকের, সেটা হলফ করে বলাই যায়৷ এবং, এ নাটকের সার্থকতাও মূলত সেখানে। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা