ভিউ, ভাইরাল আর ভাঁড়ামোর ভিড়ে ভালো অভিনেতারা ক্রমশই নিভে যাচ্ছেন। প্রশ্ন সেখানেই, এই আবহমান সংকট কাটার কি কোনো উপায় নেই? বাংলা নাটকের সুদিন কি কোনোদিন ফিরবে না আর?

লেখক শাহাদুজ্জামানের এক কলামে তিনি একবার আক্ষেপ করে লিখেছিলেন-

প্রত্যেকবার বইমেলায় তো অনেক বই বিক্রি হয়। কিন্তু হৃদয়ে দাগ কাটার মতন বই বিক্রি হয় কয়টা? 

আজকাল যে কেউ যা কিছু একটা লিখে ছাপিয়ে দুই মলাটে বন্দী করে প্রকাশ করে ফেললেই সে বস্তুটি হয়ে যাচ্ছে বই, সে মানুষটি হয়ে যাচ্ছেন লেখক। একই বিষয় দেখি, গানের বেলায়। সঙ্গীতের সাথে, সুরের সাথে, তালের সাথে সম্পর্ক না রেখে হেঁড়ে গলায় যে যত চেঁচাতে পারবে, সে তত আধুনিক গায়ক! নাটক-সিনেমায় যে যত কুশ্রী গালিগালাজ বা বিশ্রি ভাঁড়ামো করতে পারবে, সে তত জনপ্রিয় অভিনেতা। আমরা জানি, জনস্রোত ভালোমন্দ নির্ধারণ করতে পারে না। কিন্তু জনস্রোত যা নির্ধারণ করে, সেটাই দিনশেষে 'স্ট্যান্ডার্ড' হয়ে যায়। হবে নাও বা কেন, এই জনস্রোতই তো সেই তথাকথিত 'টার্গেট অডিয়েন্স'; যাদের খুশি রাখতে পারলেই ইউটিউবে মিলিয়ন ভিউ, ফেসবুকে ভাইরাল আর টিভির টিআরপি রাখা যায় তুঙ্গে। এই চলে আসা সিস্টেমে অধিকাংশেরই কোনো সমস্যা না হলেও বিপাকে পড়ে যান প্রকৃত শিল্পীরা, যারা 'শিল্প'কে ভালোবেসেই কাজ করতে এসেছিলেন এই পেশায়। 

যেমন- ফজলুর রহমান বাবু৷ মঞ্চনাটক দিয়ে শুরু তাঁর জীবন৷ মঞ্চনাটক বলতে মনে পড়লো, সত্যজিৎ রায়ের মতন মানুষও আক্ষেপ করতেন, কেন 'মঞ্চনাটক' নামক অসাধারণ বিষয়টি বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো বাংলায়। দারুণ দারুণ সব শিল্পীদের সেইসব কালজয়ী নাটকের দর্শকমহলও ছিলো শিক্ষিত। কিন্তু আস্তে আস্তে শিল্পী-দর্শক সবাই অদৃশ্য হলো এই কৃশকায়, ম্লান, অথর্ব মঞ্চ থেকে। কলকাতায় তো থিয়েটার মালিকরা শেষপর্যন্ত ক্যাবারে ড্যান্সার এবং বেশ্যালয় থেকে মেয়ে এনেও দর্শক টানতে চেয়েছিলেন৷ যদিও ততদিনে অচিন পাখি খাঁচার বাইরে চলে এসেছে।  বাংলাদেশেও স্বাধীনতার পরে থিয়েটারের কী রমরমা! সময়ের ফেরে সেসব আজ কোথায়? কে মনে রাখে? কে দেখতে যায়? কার এত সময়? 

ফজলুর রহমান বাবুর কথা বলতে গিয়ে মঞ্চের এত কথা টানছি কেন, এ প্রশ্ন উঠতে পারে। দৈনিক প্রথম আলোর একটা লেখা পড়ছিলাম। সেখানে তিনি আক্ষেপ করে বলছিলেন- ক্যারিয়ারজুড়ে মঞ্চনাটক নিয়েই থাকার ইচ্ছে ছিলো তার৷ পারেননি৷ ওখানের অকিঞ্চিৎকর টাকা দিয়ে টিকে থাকা যায় না। এলেন নাটকে। আমরা সবাই জানি, এই অসাধারন অভিনেতা ক'টা ভালো নাটকই বা পেয়েছেন! টাকার জন্যে বাধ্য হয়ে এমন সব নাটকে কাজ করতে হয়, যেখানে কাজ করতে মন টানে না। কম সময়ে 'থোড় বড়ি খাড়া' কিছু একটা বানিয়েই গছিয়ে দেয়া হয় যেন। এখানেই আক্ষেপ এই শিল্পীর৷ অথচ ভালো স্ক্রিপ্ট পেলে কী আগুন জ্বালাতে পারেন চারবারের জাতীয় পুরস্কারজয়ী এই শিল্পী, সেটা নাটক 'বিকেল বেলার পাখি', 'মায়া' অথবা সিনেমা 'অজ্ঞাতনামা' 'শঙখনাদ' 'গহীন বালুচর' যারা দেখেছেন, তারাই বলতে পারবেন ভালো।

ভালো চরিত্র না পাওয়ার কষ্ট এই মানুষটির! 

এ আক্ষেপ শুধু তাঁর না৷ এই ঈদে মোশাররফ করিমের 'গরম ভাতের গন্ধ' দেখে চোখে বাষ্প জমেনি, এমন মানুষ কমই আছেন৷ ঠিক একই ঈদে তাঁর 'যমজ' নাটকের চৌদ্দতম পর্ব প্রকাশিত হয়েছে৷ এই নাটকটি কতটা চটুল রুচির তাও সবাই জানেন। দুটি নাটকই ইউটিউবে আছে৷ প্রথম নাটকটির ভিউ কত জানেন? ৫ লাখ। আর দ্বিতীয় নাটকটির ভিউ কত? ৫২ লাখ! বিশ্বাস না হলে একটু কষ্ট করে ইউটিউবে গিয়ে মিলিয়ে নেবেন৷ অসাধারণ প্রতিভার এই মানুষ আক্ষেপ করে বলেছিলেন একবার-

সৃষ্টিশীলতার বাজারে আমি এক অপচয়!

অবিশ্বাস্য প্রতিকূলতায় যারা এই পেশায় এসেছেন, তারা খেয়েপড়ে বেঁচে থাকার জন্যে কোথায় যাবেন? কী করবেন? প্রশ্ন থেকেই যায়৷ 

হুমায়ূন ফরীদি নামের রত্নকে আমরা ব্যবহারই করতে পারিনি কোনোদিন। এটিএম শামসুজ্জামান কে চিনেছি শেষ বয়সে৷ শহীদুজ্জামান সেলিমের মত মানুষেরা এখন খানিকটা পাদপ্রদীপের আলো পাচ্ছেন৷ চঞ্চল চৌধুরী যেমন অসাধারণ সব কাজ করেন।  আবার মাঝেমধ্যে এমন সব নির্মানেও তাকে দর্শকেরা দেখেছেন, যা একঘেয়ে চরিত্রের চরিতার্থসাধন ছাড়া আর কিছুই না। তাছাড়া বাকিরা? তারা কোথায়? আমরা তাদের কোনো খবর রেখেছি? কোথায় হারিয়ে গিয়েছে তাঁরা?

হুমায়ূন ফরীদিকে কোনোদিন চিনেছি আমরা?

যাই হোক, এই লেখা হতাশা দিয়ে শেষ করবো না। আশার কিছু সমীকরণই দেখছি সম্প্রতি। গত বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে ভালো কাজ হচ্ছে। তরুণ কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী তৈরী হয়েছে যারা প্রবীণ প্রতিভাবান শিল্পীদের সাথে মিলে দারুণ কাজ করছেন৷ হ্যাঁ, তাদের কাজের সেভাবে ভিউ হচ্ছেনা, সমাদর হচ্ছেনা; এটা সত্যি। কিন্তু সাম্প্রতিককালে সেই দুর্দশার চক্র কিছুটা হলেও ভেঙ্গেছে৷ এখন মানুষ ভালো কাজের অকুন্ঠ প্রশংসা করছে৷ ভালো কাজ ছড়িয়ে দিচ্ছে দিগ্বিদিক। বলিষ্ঠ ও প্রবীণ অভিনেতা তারিক আনাম খানের 'যদি আমি না থাকি' নাটক বিস্তর বাহবা কুড়িয়েছে। মোশাররফ করিমের নাটকের কথা বললামই। তরুণ অভিনেতারাও চুটিয়ে কাজ করেছেন নানা নির্মাণে। আস্তে আস্তে এইসব কাজ এবং সেসব কাজের সামনের ও পেছনের মানুষদেরও চিনছে দর্শকেরা। এই বিষয়গুলো অবশ্যই আশাবাদী করার মতন। নির্মাতাদের মধ্যে শিক্ষিত এবং মেধাবী মুখ বাড়ছে নিয়মিত। যা আরেকটি ইতিবাচক দিক৷ 

Steven Pressfield এর 'The War of Art' বইয়ের একটা উক্তি একবার বেশ মনে ধরেছিলো- 

যে কাজ আপনার ভালো লাগে না, অথচ আপনি টাকার জন্যে তা করেন, সে কাজের সাথে বেশ্যাবৃত্তির খুব একটা পার্থক্য নেই 

কিঞ্চিৎ মোটাদাগের কথা হলেও ভেতরের ভাবটুকু আমরা হয়তো ঠিকই ধরতে পারবো৷ প্রকৃত শিল্পীরা এরকম সস্তা কাজ করে হয়তো পেটের খিদে মেটাচ্ছেন, কিন্তু মনের খিদে মেটানোর মতন কোনো রসদের ছিটেফোঁটাও নেই কোথাও। আমরা অনেকেই মাঝেমধ্যে স্বগতোক্তি করে বলি- এদেশের শিল্পজগত বন্ধ্যা। এখানে ভালো কাজ নেই। অথচ সত্যিটা হচ্ছে এই, এখানে গুনী শিল্পীর অভাব নেই। ভালো কিছু গল্প ও সঠিক দিকনির্দেশনা যদি এই শিল্পীরা পায়, দাবানলের মত পালটে যেতে বাধ্য সব। হয়তো আগুন জ্বলতে শুরু করেছে। এ আগুনেই একসময়ে স্পষ্ট হয়ে উঠবে সব। কেটে যাবে সব অন্ধকার।

সেদিনের প্রত্যাশায় রইলাম। আশা করি, ফজলুর রহমান বাবু'র মতন গুনী শিল্পীর আক্ষেপও মুছে যাবে সেদিন।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা