বাধাই দো: পুরোনো বোতলে পুরোনো মদ
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

'বাধাই দো' খারাপ সিনেমা না মোটেও। কিন্তু গল্প এবং গল্পবয়ানে সে তার পূর্বসুরীদের এতটাই অনুকরণ করেছে, ক্রমশ সে হারিয়ে ফেলেছে নিজের স্বকীয়তাই। তাই আলাদা করে এ সিনেমা নিয়ে মুগ্ধতার জায়গা নেই বললেই চলে। যা আছে, পুরোটাই অনুকরণের অভিযোগ...
একই বিষয়ে এবং একই ফরম্যাটে যখন অজস্র সিনেমা বানানো হয়ে যায়, তখন, ভালো নির্মাণ হওয়া সত্বেও, পুনরাবৃত্তির অপরাধে অপরাধী হয়ে নবতম নির্মাণগুলোর আকর্ষণ ক্রমশ ফিকে হতে থাকে। যার সাপেক্ষে সাম্প্রতিকতম নিদর্শন- বাধাই দো। রাজকুমার রাও ও ভূমি পেদনেকারের এই 'ফিল্ম উইথ সোশ্যাল মেসেজ' যে ফরম্যাটে বানানো অর্থাৎ- কমিকে শুরু, মাঝে ক্রাইসিস ও শেষে এসে হ্যাপি এন্ডিং... এই ফরম্যাটে বিগত বেশকিছু বছরে খোদ বলিউডেই এত সিনেমা হয়ে গিয়েছে, 'বাধাই দো' শুরুর বিশ মিনিটের মধ্যেই ধরতে পারা যাচ্ছিলো- সিনেমাস্রোত কোন খাতে এগোচ্ছে। এবং সিনেমার জৌলুশও ঠিক তখন থেকেই কমা শুরু৷
সিনেমার গল্প আবর্তিত হয় শার্দুল ও সুমিকে কেন্দ্র করে। শার্দুল, একান্নবর্তী পরিবারের অবিবাহিত সন্তান৷ পেশায় পুলিশ অফিসার৷ বিগত কিছু বছর ধরে শার্দুলের পরিবার তার বিয়ের জন্যে উঠেপড়ে লাগলেও সে বিয়ে করতে অনিচ্ছুক৷ কারণ একটাই- সে সমকামী। এদিকে, সুমিরও একই গল্প। ছোট পরিবারের বড় মেয়ে সুমি একটি প্রতিষ্ঠানের ফিজিক্যাল ট্রেনার। সেও অবিবাহিত। কারণ- আগের মতই। সমকামীতা। ঘটনাক্রমে শার্দুলের সাথে দেখা হয় সুমির। তারা দুজনে মিলে পরিকল্পনা করে, দুই পরিবারকে চুপ করাতে তারা মিথ্যে বিয়ের অভিনয় করবে, এবং, পোশাকি বিয়ের আড়ালে নিজেদের ইচ্ছে ও রুচিমত স্বাধীন জীবন যাপন করবে। মোটা দাগে, গল্প এটুকুই। এবং এই গল্পকে কেন্দ্র করেই সিনেমা এগোবে।

এবার, এটুকু পড়েই বুঝে ফেলবার কথা, 'বাধাই দো'র মূল যে গল্প, এ গল্প বলিউডে মোটেও নতুন না। সমকামিতা'কে কেন্দ্র করে অজস্র সিনেমা হয়েছে বলিউডে৷ সেগুলোর মধ্যে কোনোটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কোনোটি পায়নি। বিশেষ করে মনে পড়ছে, 'আলীগড়' ও 'শুভ মঙ্গল জ্যাদা সাবধান' সিনেমা দুটির কথা। 'গে কালচার' নিয়ে বেশ স্পষ্টভাবেই কথা বলেছিলো সিনেমাদুটি। সেই সিনেমাদ্বয়ের উত্তরসুরী হিসেবে এই যে সিনেমা, সেটা পূর্বোক্ত নির্মাণগুলোর সাথে গল্পজনিত সামঞ্জস্যের কারণে প্রথমেই খানিকটা ব্যাকফুটে চলে যায়। যদিও, গল্পে নতুনত্ব নেই, সেটাও বড় সমস্যা না। যদি গল্পবয়ানে চমক রাখা যায়, তাহলে খুব সাধারণ চেনা-পরিচিত গল্পও মুগ্ধ করতে পারে। এরকম উদাহরণ আশেপাশে আছেও অজস্র, যেখানে খুবই গড়পড়তা গল্পও ন্যারেশনের চমৎকারিত্বে হয়েছে দুর্দান্ত। এবং এ সিনেমার সমস্যা ঠিক এখানেই, সিনেমার 'গল্প-বয়ানে' তারা হাসি-বিষাদ-যোগ-বিয়োগ এর সে ফরম্যাটকেই অনুসরণ করেছে, যে ফরম্যাট বহু ব্যবহারে বলিউডে একরকম ছিবড়েই হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ, গল্প ও গল্পবয়ান... দুটিই দর্শকের কাছে এতটাই পরিচিত, নির্মাণের আপেক্ষিকতার পতন শুরু হয়েছে ঠিক তখন থেকেই।
'সমকামিতা' নিয়ে এ সিনেমা যা বলতে চাচ্ছে, তা হয়তো আমার কাছে পরিষ্কার, কিন্তু যেভাবে গল্পটা এগোচ্ছে, দুইজন 'গে' এবং দুইজন 'লেসবিয়ান' এর মাঝে মিথস্ক্রিয়া যেভাবে গড়াচ্ছে, তা কোথাও গিয়ে যেন মোটেও কনভিন্স করতে পারছে না৷ তাড়াহুড়ো বা খাপছাড়ার ছাপও হচ্ছে স্পষ্ট। পাশাপাশি, যে সিচুয়েশনাল কমেডিগুলো আনা হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যেও বালখিল্যতা, অদ্ভুতুড়ে ব্যাপারস্যাপার এতটাই প্রবল, সেগুলোও কেন যেন জমছে না। সন্তুষ্ট করতে পারছে না৷ যে গানগুলো আনা হচ্ছে, সেগুলো গল্পের সাথে সঙ্গত তো করছেই না, ক্ষেত্রবিশেষে বিরক্তিই তৈরী করছে। এবং গানগুলোও যেন সেই একই বলিউডি চিজি লিরিকস ও টিপিক্যাল কোরিওগ্রাফির পরাকাষ্ঠা হয়েই থাকছে। নতুনত্ব পাওয়া যাচ্ছে না।
অভিনয়ে রাজকুমার রাও, ভূমি পেদনেকার, সীমা পাহওয়া, সীবা চাড্ডা, গুলশান দেভাইয়া কিংবা চাম দারাঙ্গ খুব যে খারাপ করলেন এমন না মোটেও। কিন্তু আহামরি কিছুও বলার সুযোগ রইলো না তাদের নিয়ে। অবশ্য, নির্মাণের মূল গল্পই যদি দূর্বল হয়, তাহলে সে গল্পের চরিত্ররাও যে গড়পড়তাই হবে, মূলত সেটাই প্রাসঙ্গিক৷ হয়েছেও ঠিক তাই। বিশেষ করে, রাজকুমার রাও ও ভূমি পেদনেকারের চরিত্রদুটির উপর প্রত্যাশা ছিলো সবচেয়ে বেশি৷ রক্ষনশীল সমাজে 'সমকামী' হওয়ার যে বিষাদ, এবং সেখান থেকে পরিত্রান পাওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা... তার কোনোটাই তাদের চরিত্রতে সেভাবে ফুটে উঠলোনা, যতটা ছিলো গল্পের চাহিদা। যেটাও এক আক্ষেপ।

'বাধাই দো' খারাপ সিনেমা না মোটেও। কিন্তু গল্প এবং গল্পবয়ানে সে তার পূর্বসুরীদের এতটাই অনুকরণ করেছে, ক্রমশ সে হারিয়ে ফেলেছে নিজের স্বকীয়তাই। তাই আলাদা করে এ সিনেমা নিয়ে মুগ্ধতার জায়গা নেই বললেই চলে। যা আছে, পুরোটাই অনুকরণের অভিযোগ। এবং 'কমার্শিয়াল মোড়কে সোশ্যাল মেসেজ' দেয়ার এ টেকনিক যদি এভাবেই চলতে থাকে সামনেও, তাহলে যে নির্দিষ্ট এই জঁরার দর্শক ক্রমবর্ধমান হারেই কমবে, তাও বলা যায় নির্দ্বিধায়। আশা করি, সামনে থেকে নির্মাতারা এই বিষয়গুলোতে সাবধান হবেন। মনোযোগী হবেন। নাহয়, সংকট সমাচ্ছন্ন।