মাত্র ছত্রিশ বছরের এই ফিল্মমেকারের ট্রফিকেসে আছে অজস্র ট্রফি। 'ম্যাস পিপল' এর মাইন্ডসেটও খুব ভালো বোঝেন তিনি। তার সিনেমাতে রিফ্লেক্ট হয় ম্যাস-সেন্ট্রিক সে ন্যারেশনও৷ তবুও, এতসব ভালো দিক থাকতেও, সমালোচনা কেন যেন পিছু ছাড়ে না তার! ভুল সংবাদের শিরোনামে কেন যেন মাঝেসাঝেই পড়তে হয় তাকে!

যে পরিচালককে নিয়ে কথা বলছি, সে পরিচালকের ফিল্ম-ক্যারিয়ার বেশ ঈর্ষণীয়। এখন পর্যন্ত চারটি সিনেমা বানিয়েছেন, এবং, চারটিই হিট! এবং, সামনে যে সিনেমা আসতে যাচ্ছে তার, সেটা নিয়েও জল্পনা-কল্পনা তুঙ্গে। মাত্র ছত্রিশ বছরের এই ফিল্মমেকারের ট্রফিকেসে আছেও অজস্র ট্রফি। 'মাস পিপল' এর মাইন্ডসেটও খুব ভালো বোঝেন তিনি। তার সিনেমাতে রিফ্লেক্ট হয় মাস-সেন্ট্রিক সে ন্যারেশনও৷ তবুও, এতসব ভালো দিক থাকতেও, সমালোচনা কেন যেন পিছু ছাড়ে না তার! ভুল সংবাদের শিরোনামে কেন যেন মাঝেসাঝেই পড়তে হয় তাকে! তিনি অরুণ কুমার। যাকে সিনেমাপ্রেমীরা 'অ্যাটলি' নামেই চেনে। 

২০১৯ সাল। চেন্নাইয়ের এম এ চিদাম্বরম স্টেডিয়াম৷ খেলা চলছে 'চেন্নাই সুপার কিংস' ও 'কলকাতা নাইট রাইডার্স' এর মধ্যে। শাহরুখ খান বসেছেন ভিআইপি গ্যালারিতে৷ তার পাশে অ্যাটলি। বাতাসে জোর ফিসফাস- অ্যাটলির সিনেমাতে হয়তো যুক্ত হবেন শাহরুখ খান৷ সেজন্যেই হয়তো দু'জন একসাথে। কিন্তু, বিস্মিত হতে হলো, যখন নেটিজেনরা 'শাহরুখের সাথে অ্যাটলির কিরকম কোলাবোরেশান হতে পারে' তা নিয়ে আলোচনা আচমকাই থামিয়ে কথাবার্তা শুরু করলো 'অ্যাটলির গাত্রবর্ণ' নিয়ে! এবং, অল্পক্ষণের মধ্যেই যে আলোচনা বাঁক নিলো চূড়ান্ত নোংরামোতে৷ বর্ণবাদী মন্তব্যের এমন সব পসরা সাজিয়ে বসলেন আমজনতারা, যে মন্তব্য ভদ্রস্থ-অভদ্রস্থ কোনো গণ্ডির অধীনেই আর রইলোনা। সব ছাড়িয়ে চলে গেলো বহুদূর। 

আইপিএলের এই ছবিই নেটদুনিয়ায় তুলেছিলো ঝড় 

অথচ, বিষয়টা এরকম হওয়ার কথা ছিলো না মোটেও। যে ডিরেক্টরের 'থেরি' দেখেনি এমন মানুষ নেই বললেই চলে, যে ডিরেক্টরের ক্যারিয়ারের সবগুলো সিনেমাই হিট, মনি রত্নমের পরে যে তামিল ডিরেক্টরই প্রথম শাহরুখ খানের সাথে কাজ করছেন, তাও এমন এক সময়ে, যখন 'কিং খান' এর ক্যারিয়ারও বেশ শোচনীয়... এরকম এক পরিস্থিতিতে 'অ্যাটলি'কে নিয়ে যেসব সংবাদ হতে পারতো, তার কিছুই না হয়ে তিনি হলেন যেসব 'ভুল' সংবাদের শিরোনাম, তা বেশ হতাশই করলো। পাশাপাশি, অ্যাটলি'র দুর্ভাগ্যেরও খানিকটা যেন নিদান পাওয়া গেলো এই টুকরো ঘটনার বরাতে৷

যদিও, এও ঠিক, গাত্রবর্ণের বরাতে এরকম সোশ্যাল বুলি তিনি যে প্রথমবার শুনলেন, বিষয়টা এমনও না। তিনি এরকম 'কৃষ্ণকায়' হয়েও কিভাবে 'প্রিয়া'র মত সুন্দরী অভিনেত্রীকে বিয়ে করতে পারলেন, কিভাবে নয়নতারা ও সামান্থা'র মত গ্ল্যামারাস নায়িকারা তার কাছের বন্ধু... তা নিয়ে রসালো আলোচনা, দেঁতো রসিকতা বহুদিন ধরেই চাউর নেটিজেনদের মধ্যে। যদিও এসব আলোচনায় অ্যাটলি কখনোই দৃকপাত করেননি, তবুও খারাপ লাগা তো থাকেই। থাকা উচিতও। ছিলোও। 

অ্যাটলি'র ক্যাপাবিলিটি নিয়ে যদি কথা হয়, তাহলে রসালো আলাপ সেখানে যে পাত্তা পায়না মোটেও, সেটা ধ্রুবসত্যি। কারণ, ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই অ্যাটলি'র জার্নিটা বেশ ঈর্ষণীয়। প্রথমত, মাস্টার ডিরেক্টর শঙ্করের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে তিনি ছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম। তিনি ছিলেন শঙ্করের সবচেয়ে কাছের অ্যাসিস্ট্যান্টও। এবং, গুরু-শিষ্যের এই জমাটি রসায়নের ফলাফলেই কি না, যখন অ্যাটলি সিনেমা বানানো শুরু করলেন, তখন তিনি বেছে নিলেন গুরুর দেখানো পথই; অর্থাৎ- বিগ স্কেল আর মাস অডিয়েন্সকে ঘোল খাওয়ানোর খেলা! 

লার্জ স্কেলে সিনেমা বানানোর একটা বড় ডিফিকাল্টি, বিশাল বড় ইউনিটকে খুব স্ট্রংলি কন্ট্রোল করতে হয়। অ্যাটলি এ কাজেও, তার দ্রোনাচার্য'কে অনুসরণ করলেন সর্বান্তকরণে। যে কারণেই, অ্যাটলির প্রথম সিনেমা 'রাজা রানী' ক্লিন ব্লকবাস্টার। যদিও, অনেকে এ সাফল্যকে দেখেছিলেন 'অ্যাক্সিডেন্ট' হিসেবে। তাদের মতামতও ছিলো অনেকটাই এরকম- হয়তো দূর্ঘটনাবশত একটা সিনেমা হিট হয়েছে। কিন্তু, পরের বারেই হবে ভরাডুবি। যদিও, নিন্দুকদের সে আশার গুড়ে বালি দিয়ে, বহুকাঙ্ক্ষিত সে ভরাডুবি কখনোই আসেনি। বরঞ্চ, এই অ্যাটলি'ই একের পর এক দিয়ে গিয়েছে হিট সিনেমা। তার সিনেমার বাজেট ত্রিশ কোটি থেকে দেড়'শো কোটির চৌহদ্দি অতিক্রম করেছে, তার সিনেমায় এ আর রহমানের মত মায়েস্ত্রো কিংবা বিজয়ের মত তামিল সুপারস্টার এসেছে, বিগ বাজেটের সিনেমাকে তিনি নিয়মিত দেখিয়েছেন লাভের মুখ...এসবের মিলিত ফলাফলে, মানুষও ক্রমশ বুঝেছে, অ্যাটলি আচমকা উদয় হয়ে দুম করে হারিয়ে যেতেও আসেননি। তিনি এসেছেন কমার্শিয়াল ফিল্মের এক্সপার্ট ডিরেক্টর হতেই। সেজন্যেই এত আয়োজন। এতকিছু।

যদিও, নিন্দুকেরা এসব দৃষ্টান্তেও হয়নি হতোদ্যম। অ্যাটলি যতই সাফল্য পেয়েছে, ততই তারা খুঁজে বের করেছে একের পর এক খুঁত। তারা অ্যাটলির প্রত্যেকটা সিনেমাতেই খুঁজে পেয়েছে পুরোনো সিনেমার ছায়া। সেসব নিয়ে তারা চালিয়েছে অপপ্রচারও।  বলা যেতে পারে, 'থেরি' সিনেমার কথা। নিন্দুকদের জোর দাবী, অ্যাটলির এ সিনেমাটা নাকি অনেকটুকুই মিলে যায় বিজয়কান্ত'র 'সাথরিয়ান' এর সাথে, 'মার্শাল' মিলে যায় কমল হাসানের 'আবুর্ভা সাগোডারগাল' এর সাথে। অনেকে এও বলেন- অ্যাটলির প্রথম সিনেমা 'রাজা রানী'র সাথে নাকি মিল আছে মনি রত্নম এর 'মওনা রগম' এর। এসব দাবীর সবগুলোই যে অমূলক, এমনও না৷ মিল আছেও অল্পবিস্তর। আবার, কাউন্টার লজিকে এও বলা যায়- মোটাদাগে সব কমার্শিয়াল সিনেমার গল্পই তো একইরকম৷ উনিশ বিশ। মেইনস্ট্রিম সিনেমার গল্পে আহামরি চমক ছিলোও বা কবে? বরং, এখানের মূল পার্থক্য তো এক্সিকিউশনের মুন্সিয়ানায়! আর, সে মুন্সিয়ানায় অ্যাটলির ধারেকাছে কয়জন আছে, সেও তো সবারই জানা। কিন্তু, সেসবকে উপেক্ষা করে যখন 'পান থেকে চুন খসা'র অপরাধকেই করা হয় সর্বেসর্বা, তখন অ্যাটলি'কে 'দুর্ভাগা' ভাবা ছাড়া আর করার থাকেওবা কি? 

তামিল ইন্ডাস্ট্রির যে টিপিক্যাল অডিয়েন্স, তাদের একটা অদ্ভুত প্রিন্সিপল হলো- এই ইন্ডাস্ট্রির কোনো ডিরেক্টরের পরপর সিনেমা যদি ফ্লপও হয়, তাহলেও তারা সে ডিরেক্টরকে সম্মান করে, যদি ডিরেক্টরের অ্যাটেম্পটগুলো অরিজিনাল প্লটের হয়। অর্থাৎ, সোজা বাংলায়- সিনেমার প্লট যদি অথেন্টিক হয়, তাহলে সে সিনেমা ফ্লপ করলেও সমস্যা নেই। এবং, এই পয়েন্টেই ক্রমশ কন্ট্রোভার্সি হয়েছে 'অ্যাটলি'কে নিয়ে। যিনি টানা সুপারহিট ফিল্ম বানালেও, সেসব সিনেমার অথেন্টিসিটি নিয়ে প্রতিবারেই প্রশ্ন তোলা হয়েছে৷ ফলাফল- যতটুকু অর্জন প্রাপ্তি ছিলো তার, তা তিনি পাননি। যদিও, মেইনস্ট্রিম ডিরেক্টররা নতুন সিনেমা বানানোর ক্ষেত্রে ভিন্টেজ ফিল্মগুলো থেকে ইন্সপিরেশন আকছারই নেন। আর সেটা কিছুক্ষেত্রে পুরোনো সিনেমার রিভাইভালেও কাজ করে। তবুও, যত দোষ, সব যেন অ্যাটলি ঘোষ এর উপরেই এসে পড়েছে বারবার। আগের সিনেমা থেকে ইনস্পিরেশন যেখানে গোটা পৃথিবীতে কমন প্রাকটিস, সেটা অ্যাটলির প্রেক্ষাপটে এসেই যেন সেটা হয়েছে অমার্জনীয় অপরাধ! অমোচনীয় পাপ! 

অ্যাটলিকে নিয়ে এই যে রাতদিন সমালোচনা-বিদ্রুপ, আক্রমণ... তার পেছনে শুধু যে বর্ণবাদ, কপি ফিল্মের গুজবই প্রোটাগনিস্ট, সেটাও পুরোপুরি ঠিক না। এখানে অন্যান্য কারণও আছে৷ যার মধ্যে অন্যতম, বিজয়- অজিত বিরোধ। যারা তামিল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির গতিবিধি নিয়ে মোটামুটি হলেও খবর রাখেন, তারা বেশ ভালোভাবেই জানেন, বিজয়ের ফ্যানবেজ এবং অজিতের ফ্যানবেজের মধ্যবর্তী রাইভারলি, তামিলের প্রধানতম টক্সিক রাইভারলিগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। এবং, সেই রাইভারলির ভস্মে  ক্রমাগতই ঘি ঢেলেছেন অ্যাটলি। 'বিজয়'কে নিয়ে বানিয়েছেন সিনেমা! তাও, একটি দুটি নয়। তিনটি! এবং, তিনটিই হিট! এরপরের বাকিটুকু বোধহয় না বললেও চলে। বাকিটুকু লেখা বাহুল্যও। তবুও যদি একবাক্যে বলি- তিনি অজান্তেই হয়েছেন কিছু মানুষের চক্ষুশূল। 

'বিজয়'কে নিয়ে তিনি বানিয়েছেন টানা তিনটি সিনেমা! 

এ প্রসঙ্গে একটা আশার কথা জানিয়ে রাখা ভালো,  'বিজয়-অ্যাটলি'র ট্রিলোজি যারা দেখেছেন, তারা একটা বিষয় নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন- 'অ্যাটলি'র সিনেমাগুলোতে 'বিজয়' এর‍ যে সুপারস্টার তকমা, সেটা কখনোই ম্লান হয় নি। অর্থাৎ, 'অ্যাটলি' প্রতিবারেই খুব সাটলভাবে বিজয়ের স্টারডম আর সিনেমার মেইন স্টোরিকে ব্লেন্ড করেছেন একসাথে। গল্প যেমনই হোক, চরিত্র যেমনই হোক, বিজয়ের স্টারডম'কে প্রত্যেকবারই আলাদাভাবে স্পষ্ট রেখেছেন অ্যাটলি। ফলাফল- বিজয়ের ফ্যানবেজ লুফে নিয়েছে সিনেমাগুলোকে। এবার, ভাবুন তো, অ্যাটলি তার 'জওয়ান' সিনেমায় শাহরুখ খানের 'স্টারডম'কে ব্লেন্ড করলেন গল্পের সাথে, সে সাথে যুক্ত হলো বাকিসব মাসালা এলিমেন্টস, কেমন হবে বিষয়টা! ফুড ফর থট! দিলাম। 

অ্যাটলির পক্ষে-বিপক্ষে অনেকে অনেক কথা বললেও, একটা বিষয় সবাই স্বীকার করেন, অ্যাটলি প্রচণ্ড পরিশ্রমী একজন ডিরেক্টর। পাশাপাশি, বিগ ক্যানভাসের সিনেমাকে পুল অফ কিভাবে করতে হয়, তাও তিনি বেশ ভালোভাবেই জানেন। তিনি কোনো একটা সিনেমার কোনো এক বিশেষ দৃশ্য থেকে ঠিক কি চান, কিভাবে চান... সেটা সম্পর্কে টিমকে বেশ ভালোভাবেই ডিরেকশন দিতে পারেন তিনি। যে কারণে, 'অ্যাটলি'র সিনেমায় বাজেট যতই থাকুক, অ্যাটলির সেট যত বিস্তৃতই থাকুক, গোছানো কর্মযজ্ঞে কখনোই উটকো বিশৃঙখলা হয় না। আবার, সবকিছু সামলে পর্দায় যে গল্পটা তিনি বলেন, সেটাও ঠিকঠাক স্টাবলিশ হয় দর্শকের সামনে, দর্শকও কানেক্ট করতে পারে। অর্থাৎ, এটা বলাই যায়- ক্রাউড সামলে এভাবে আস্থার সাথে পারফর্ম করে যাওয়াটাই অ্যাটলি'র কব্জির মোচড়, এক্স ফ্যাক্টর! 

পরিশ্রমী এক নির্মাতা তিনি

অ্যাটলির সামনের সিনেমা বলিউডের সিংহাসনচ্যুত বাদশা'কে নিয়ে, যে বাদশা নিজেও মসনদে বসার জন্যে উদগ্রীব। পাশাপাশি, এ সিনেমা অ্যাটলি'র জন্যেও এক লিটমাস টেস্ট৷ তিনি যে ক্লিন স্টোরি আর ক্লিন হিট একসাথেই দিতে পারেন, সেটারও এক পরীক্ষাকেন্দ্র এই সিনেমা। মূলত, সে কারণেই, শাহরুখ-অ্যাটলি দুইজনেই 'জওয়ান' নিয়ে মরিয়া। অনিরুদ্ধ'র মিউজিক ডিরেকশন, নয়নতারা'র শক্তিশালী রোল, বিজয় সেথুপতির ক্যামিও অ্যাপিয়ারেন্স, অ্যাটলির ডিরেকশন আর শাহরুখের অভিনয়... 'জওয়ান' যেভাবে ঠাসা বারুদে উত্তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ছে, চমৎকারিত্ব যে হবেই, তাতে এখন পর্যন্ত নেই কোনো সন্দেহ। শাহরুখের এত বছর ধরে গড়ে তোলা ঈর্ষণীয় স্টারডম, সাথে অ্যাটলির ডিরেকশন, ডিরেকশন আর স্টারডমের মিশেলে রূপান্তরিত গল্প, আর সে গল্পের পরিণতি.. সবটুকুই এখন দেখার অপেক্ষা। জায়ান্ট স্ক্রিনে 'অ্যাটলি-শাহরুখ' এর পার্টনারশিপ দেখার অপেক্ষা। 'জওয়ান' এর অপেক্ষা। বহুদিন ধরে চলতে থাকা কিছু শোরগোলের কি জবাব দেবেন শাহরুখ খান ও অ্যাটলি কুমার... সেটাও দেখার অপেক্ষা।

তথ্যসূত্র- ফিল্ম কম্প্যানিয়ন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা