মানসিক কাউন্সেলরের চরিত্রে অভিনয় করা খ্যাতিমান অভিনেতা আসিফ বাসরা, 'ফ্যামিলি ম্যান-০২' এর শুটিং শেষ হবার কিছুদিন পরেই আত্মহত্যা করেন। যে মানুষটি পর্দায় মানুষের মানসিক অস্থিরতা দূর করার দায়িত্বে নেমেছিলেন, বাস্তব জীবনে তিনিই মানসিক দৈন্যের সাথে লড়াইয়ে স্বীকার করেন পরাজয়...

একবার এক ডাক্তারের চেম্বারে উপস্থিত হলেন মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ। ডাক্তারকে জানালেন, তিনি সারাদিন বিষন্ন থাকেন। কোনোভাবেই মন ভালো রাখতে পারেন না। ডাক্তার বুঝলেন, এই ভদ্রলোকের সমস্যা মানসিক। শারীরিক না। ডাক্তার লোকটিকে পরামর্শ দিলেন, পাশের গ্রামে চলা এক সার্কাসে গিয়ে শো দেখতে আসতে। সেখানে জোকারের কার্যকলাপ দেখলে, তিনি না হেসে পারবেন না। তখনই মন ভালো হয়ে যাবে। সেই মধ্যবয়স্ক মানুষটি তখন বিষন্নভাবে সামান্য হেসে বললো-

আমিই সেই জোকার। 

জাপানের এক প্রবাদ অনুযায়ী বলা হয়, প্রতিটি মানুষের তিনটা মুখোশ থাকে। একটি মুখোশ সে বাইরে দেখায়৷ একটা মুখোশ দেখায় কাছের মানুষকে। আরেকটি মুখোশ সে রাখে নিজের জন্যে। তাই মানুষের বাইরের মুখোশের অবয়ব দেখে কখনোই বোঝার উপায় থাকে না, কতটা তোলপাড় চলছে ভেতরে। রহস্যের সে খাসমহল যিনি পুষে রাখেন, লড়াই শুধু তারই। 

গত সপ্তাহে মুক্তি পাওয়া 'ফ্যামিলি ম্যান' এর দ্বিতীয় সিজন আমরা অনেকেই দেখেছি৷ সেখানে সুচি আর শ্রীকান্ত তাদের ভেঙ্গে যাওয়া সম্পর্ক মেরামত করার জন্যে এক ম্যারেজ কাউন্সেলর কাছে যান৷ এই কাউন্সেলর তাদের জীবনকে উপভোগ করতে বলেন। সম্পর্ক শক্ত করা বিষয়ে নানা টিপসও দেন। কিছু কমিক রিলিফও আমরা পাই এই চরিত্র থেকে। 

'ফ্যামিলি ম্যান টু' এর কাউন্সেলর চরিত্রে আসিফ বাসরা! 

এই কাউন্সেলরের চরিত্রে অভিনয় করা খ্যাতিমান অভিনেতা আসিফ বাসরা, ফ্যামিলি ম্যান-০২ এর শুটিং এর কিছুদিন পরেই আত্মহত্যা করেন। যে মানুষটি পর্দায় মানুষের মানসিক অস্থিরতা দূর করার দায়িত্বে নেমেছিলেন, বাস্তব জীবনে তিনিই মানসিক দৈন্যের সাথে লড়াইয়ে হেরে শ্রান্ত হয়ে চিরবিদায় নেয়ার এ সংবাদে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম।

আসিফ বাসরা'কে প্রথম দেখেছিলাম অনুরাগ কাশ্যপের 'ব্ল্যাক ফ্রাইডে' মুভিতে। সেই সিনেমায় 'শাহনেওয়াজ কুরেশি' চরিত্রে অল্প রানটাইমের এক পারফরম্যান্স ছিলো তার। কিন্তু কী গুছিয়েই না করলেন অভিনয়! করবেন নাও বা কেন! থিয়েটার থেকে উঠে আসা মানুষ তিনি। অভিনয়ে হাত পাকিয়ে এরপরেই তো আসা সিনেমায়। কাই পো চে, তাসখান্ড ফাইলস সিনেমায় অভিনয় করেছেন। 'জাব উই মেট' সিনেমায় তার অভিনয় এখনো লোকের মুখে মুখে ফেরে। ইমতিয়াজ আলীর 'জাব উই মেট' এ কারিনার সাথে রেল-স্টেশনের সেই সিনের আগে কারিনা নার্ভাস ছিলেন খানিকটা৷ আসিফ তখন দায়িত্ব নিয়ে কথাবার্তা বলে কারিনার নার্ভাসনেস কাটান। এরপরেই দুর্দান্ত শটটা উতরে যায়। 

এই কাজ তিনি প্রায়ই করতেন৷ সিনের আগে ভয় পেতো  অনেকে অভিনেতাই। যাদের সাথে আসিফের শুট থাকতো, তাদের ভয় কাটানোর দায়িত্ব নিতেন এই মানুষটি৷ প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়লো, মনোজ বাজপায়ীর মতন অভিনেতাও শুটের আগে ভুলেও আয়নার দিকে তাকাতেন না। আয়নার দিকে তাকালেই তিনি নার্ভাস হয়ে যেতেন৷ জানি না, 'ফ্যামিলি ম্যান-০২' এর সময়ে কাউন্সেলরের সাথে সেই দৃশ্যের শুট করার আগে মনোজের ভয় কাটিয়েছিলেন কি না আসিফ। 

খুব যে বড়সড় চরিত্রে অভিনয় করতেন, তাও না। তবে যেসব চরিত্রে ছিলেন, সেসব চরিত্রে নিজের মত করেই ছাপ রেখে যেতেন তিনি। অনেক মানুষই আছেন, যারা তাকে নামে চিনতেন না। চিনতেন অভিনয়ে। একজন অভিনেতার সাফল্য হয়তো এখানেই। অভিনয়ের মধ্য দিয়ে সবার কাছে পৌঁছে যাওয়ার যে তাকদীর, তা সবার হয়ও তো না। 

তাঁর হাসির ভক্ত ছিলেন সবাই! 

​ম্যাকলয়েডগঞ্জের নিজের প্রাইভেট বাংলো থেকে যখন তার লাশ বের হচ্ছে অন্তিম যাত্রার উদ্দেশ্যে, তার আগে তিনি কাজ করে ফেলেছেন অনেকগুলো ভাষার সিনেমা, সিরিজে। হিন্দি, গুজরাটি, তামিল, মালায়ালাম সিনেমায় অভিনয় করেছেন। ইংরেজি সিনেমা 'আউটসোর্সড' এবং 'ওয়ান নাইট উইথ দ্য কিং' এও অভিনয় করেছেন তাবড় সব অভিনেতাদের সাথে।

কাছের অনেক মানুষেরই ধারণা, বেশ অনেকদিন ধরেই ডিপ্রেশনে ছিলেন তিনি। সিনেমা-সিরিজে পর্যাপ্ত সুযোগ পাওয়া না থেকেই নাকি এই ডিপ্রেশন। কিন্তু এ যুক্তি খুব একটা ধোপে টেকে না৷ তিনি দারুণ দারুণ সব নির্মানের সাথেই যুক্ত ছিলেন। হিচকি, কৃষ থ্রি'র মতন সিনেমাতেও তার দারুণ উপস্থিতি ছিলো। এমনকি বর্তমান সময়ে ভারতের দুটি বেস্ট টিভি সিরিজ- 'পাতাল লোক' এবং 'দ্য ফ্যামিলি ম্যান'এও ছিলেন। কাজ নিয়মিতই আসছিলো তার কাছে। তবু কোথায় যে সুর কেটে গিয়েছিলো, তা জানা নেই কারো। 

এই গুণী মানুষটির মৃত্যু বিষাদগ্রস্ত করার পাশাপাশি মানুষের মানসলোকের রহস্যময়তার দিকেও অখণ্ড কৌতূহলের এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। পর্দার বাইরেও প্রতিটি মানুষই যে যাবজ্জীবন নানা চরিত্রে অভিনয় করেই শেষ করেন পাণ্ডুলিপি, সেটাও খুব নগ্নভাবে বুঝিয়ে দিয়ে যায় এই প্রয়াণ। 

শ্রদ্ধা রইলো এই গুণী অভিনেতার প্রতি। ওপারে ভালো থাকবেন, সেটাই প্রার্থণা। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা