আপনারা কি ফ্রিতে খারাপ কোয়ালিটির, সাব-স্ট্যান্ডার্ড, নিম্নমানের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি চান? নাকি মিনিমাম একটা টাকা খরচ করে, ভালো কোয়ালিটির আর্ট-কালচার উপভোগ করতে চান? সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে...

হুমায়ুন ফরিদী - তার জীবনে সবচেয়ে ভালো যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন, সেটা হচ্ছে, কমার্শিয়াল বাংলা ছবিতে অভিনয় করা। এই একটা দারুণ সিদ্ধান্তের কারণে, ভদ্রলোক টাকার অভাবে, বিনা চিকিৎসায়, ধুঁকে ধুঁকে, দুঃস্থ শিল্পী হিসাবে মারা যান নাই। উনি যে মাপের অভিনেতা, তাতে আর্টফিল্মেই ওনার স্যুট করার কথা। সেটা না করে, পয়সার জন্য উনি যে কমার্শিয়াল বাংলা ছবি করেছেন - এই সিদ্ধান্তটাকে আমি দাঁড়িয়ে স্যালুট জানাই। 

কমার্শিয়াল সিনেমাই বাঁচিয়ে রেখেছিলো একজন শিল্পী ফরিদীকে! 

একজন শিল্পী হাওয়া-বাতাস খেয়ে বাঁচে না। তারও টাকার দরকার আছে। দেশে আর্টফিল্ম হয় হাতে গোণা কয়েকটা। সেই টাকায় তো সংসার চলে না। আর্টফিল্মের ফরিদী, ভালো নাটকের ফরিদী, থিয়েটারের ফরিদীর বেঁচে থাকার জন্য, স্বচ্ছল ভাবে সংসার চালানোর জন্য যে টাকা দরকার ছিলো, কমার্শিয়াল বাংলা ছবি করে উনি সেটা আয় করেছেন, এবং খুব ভালো কাজ করেছেন। 

একই কথা হুমায়ুন আহমেদের ক্ষেত্রেও খাটে। "শঙখনীল কারাগার" আর "শ্রাবণ মেঘের দিন" বানালে যা আয় হয়, তাতে সংসার চলার কথা না। এইজন্যই কমার্শিয়াল বইপত্র লিখেছেন, হাসির নাটক বানিয়েছেন। আইয়ুব বাচ্চুর মতো রকস্টার "বারো মাস তোমায় ভালোবাসি" আর "এক আকাশের তারা" টাইপের গান গেয়েছেন। 

প্রয়োজনে ফরমায়েশি লেখা লিখতে হয়েছে হুমায়ুন আহমেদকেও! 

সবই টাকার জন্য। এখানে লজ্জার কিছু নাই। আমার সংসার তো ভাই আপনি চালিয়ে দিবেন না। আমাকেই চালাতে হবে। বাংলাদেশে ফুল টাইম "শুদ্ধ ধারার" আর্ট-কালচার করলে যা আয় হয়, তাতে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলছি - আপনার সংসার চলবে না। টাকার তাগিদে আপনাকে এন্তার শস্তা কাজ করতে হবে। 

যদি "শুধুমাত্র" কোয়ালিটি কাজই চান, তাহলে শিল্পীর ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তা আপনাকে দিতে হবে। সবাই তো আর জমিদারের ব্যাটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর না। ভাত-কাপড়ের চিন্তা না থাকলে, একজন শিল্পী প্রোপারলি আর্ট-কালচারকে ফুল টাইম জব হিসাবে নিতে পারবে, এবং তার সম্পূর্ণ সময় শিল্পের পিছে ব্যয় করতে পারবে। এরকমই হওয়া উচিত। 

চাকরি করি, পাশাপাশি লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছি - এইভাবে হয়না। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি - দিজ আর ব্লাডি ফুল টাইম জবস। শিল্পীকে ফুল টাইম আর্ট-কালচারের মধ্যে বসবাস করতে দেন, এরপর দেখেন সে আপনাকে কোয়ালিটি ডেলিভারি দিতে পারছে কিনা। 

আপনারা জানেন যেঃ "প্যাট্রিওন" নামে একটা ওয়েবসাইট আছে। শিল্পীরা এখানে একাউন্ট খোলে। যারা সেই শিল্পীকে সাপোর্ট করতে চায়, তারা এখানে সাধ্যমতো ডোনেট করতে পারে। দুই ডলার, পাঁচ ডলার, দশ ডলার - এইভাবে সারা দুনিয়া থেকে ডোনেশন এসে ভালো একটা এমাউন্টের টাকা জমে। তাই দিয়ে শিল্পীর সংসার চলে। 

আমাদের বাউল-বয়াতী, ফকির-দরবেশরাও এভাবেই সংসার চালিয়েছেন। মানুষের বাড়ির উঠানে গিয়ে গান শুনিয়েছেন। বিনিময়ে চাল-ডাল, আলু-সবজি পেয়েছেন। ইন্ডিয়া-পাকিস্তান, মিডল ইস্টে শিল্পীর কাজে খুশি হয়ে "অন দ্য স্পট" টাকা ছুঁড়ে দেয়া হয়। ইউরোপে শিল্পীরা পারফর্মেন্সের পরে টুপি খুলে সামনে রাখে, মানুষ সেখানে ডোনেশন দেয়। 

আমাদের বাপ-দাদা, পূর্বপুরুষের ধারা অনুযায়ী শিল্পের চরিত্রই তো এইরকম। আপনারা শিল্প থেকে আনন্দ পেয়ে টাকা দিবেন, তাই দিয়েই শিল্পী জীবিকা নির্বাহ করবে। চাকরি করা তো শিল্পীর কাজ না। সে চাকরি করার জন্য জন্মায় নাই। 

গৌতম বুদ্ধ আমাদের অঞ্চলে জন্মাইছেন। সম্ভবত এইজন্যই, আমরা যাবতীয় ধর্মপ্রচারক, জ্ঞানী ব্যক্তি, শিল্পী থেকে শুরু করে প্রত্যেক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে - "গৌতম বুদ্ধের ছায়া" হিসাবে কল্পনা করার একটা প্রচেষ্টা চালাই। আমাদের অঞ্চলের ভালো মানুষ মানেই - সে কতোখানি গৌতম বুদ্ধ হইতে পারছে, তার একটা পরিমাপ। 

যার কোনো ক্ষুধা-তৃষ্ণা নাই, জাগতিক টাকা-পয়সা, ধন-দৌলতের উপরে যার কোনো লোভ নাই, ছোটোখাটো মহাত্মা গান্ধী বা ঋত্বিক ঘটক, যে ভালো কাপড় পরতে পারবে না, বিলাসের মধ্যে থাকতে পারবে না, যার জীবনে যৌনতা থাকবে না - এইসব হাস্যকর মাপকাঠির মাধ্যমে আমরা "ভালো মানুষ" চরিত্রটা তৈরি করেছি। 

এই অঞ্চলে বড়লোক শিল্পী মানেই খারাপ। যৌনতাকে স্বীকার করা হুমায়ুন আজাদ খারাপ। শাওনকে বিয়ে করা হুমায়ুন আহমেদ খারাপ। মদ্যপান করা শামসুর রাহমান খারাপ। পাঁচ বিয়ে করা, ধর্ম পরিবর্তন করা কবীর সুমন খারাপ। 

লেখা বাদে অন্যান্য বিষয়ে হুমায়ুন আজাদকে সমালোচিত হতে হয়েছে বেশি

শিল্পীর ব্যক্তিজীবন নিয়ে বাঙালির আগ্রহ প্রবল। অথচ, ব্যক্তিজীবনে লোকটা খেতে পাচ্ছে কিনা - সেইদিকে কারো নজর নাই। বাবারে, পার্সোনাল লাইফে হাত দিলে সবখানেই হাত দে! টাকা-পয়সাতেও হাত দে। শিল্পী খাইতে না পাইলে তাকে খাইতে দে? দিবি? টাকা দেয়ার বেলায় পালায় যাস কেন?

লুইচ্চা কবি, বিকাশ কবি, নারীলোভী, নারীবিদ্বেষী - যে বিশেষণই লাগান না কেন, আখতারুজ্জামান আজাদ লোকটাকে আমি পা থেকে মাথা পর্যন্ত শ্রদ্ধা করি। এই লোকটা, সরাসরি, কোনো লজ্জার তোয়াক্কা না করে - নিজের লেখার নিচে বিকাশের একাউন্ট ডিটেলস দিয়ে দেন। লেখা পড়ে কেউ যদি তাকে ফাইন্যান্সিয়ালি সাপোর্ট করতে চায়, তাহলে করতে পারে। আমি মনে করি, প্রত্যেক শিল্পীরই এই কাজটা করা উচিত। 

মানুষকে শিল্প-সাহিত্য দিয়ে এন্টারটেইন করা - এইটা একটা পেশা। এই কাজের বিনিময়ে অবশ্যই টাকা-পয়সা নেয়ার দরকার আছে। আখতারুজ্জামান আজাদ ওয়ান হান্ড্রেড পার্সেন্ট সঠিক কাজ করছেন, এবং যেসব শিল্পী ফুল টাইম আর্ট-কালচারের সাথে জড়িত - তাদের সবার এই কাজ করা উচিত। মাথা উঁচু করে করা উচিত। কাজের বিনিময়ে টাকা নেয়াতে লজ্জার কিচ্ছু নাই। 

পারিশ্রমিক হিসাবে নেয়া টাকা - হান্ড্রেড পার্সেন্ট হালাল টাকা। আমি জোর দিয়ে বলছি, আপনারা সবাই লাজ-লজ্জা বাদ দিয়ে এই কালচারটা শুরু করেন। শিল্পের বিনিময়ে পারিশ্রমিক নেয়াটা নরমালাইজ করেন। আমাদেরও সংসার চালাইতে হয়, ম্যান! সংসারটা আপনারা চালায় দেন, দেখেন এরপর কী কী মণিমুক্তা আমরা প্রোডিউস করি!

এই কালচার শুরু হলে - অনেক শিল্পী তৈরি হবে। শিল্পী একটা ব্রিদিং স্পেস পাবে। জীবিকার আশংকা যে জীবনে নাই, সেই জীবনে শিল্প-সাহিত্য নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ আছে। চাকরি করলে এইগুলা সম্ভবই না। যে কোনো একটা করতে হবে। হয় ফুল টাইম চাকরি, না হয় ফুল টাইম শিল্প।

আপনারা কি ফ্রিতে খারাপ কোয়ালিটির, সাব-স্ট্যান্ডার্ড, নিম্নমানের - শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি চান? নাকি মিনিমাম একটা টাকা খরচ করে, ভালো কোয়ালিটির আর্ট-কালচার উপভোগ করতে চান? সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে। 

আপনার প্রেমিকাকে গোলাপ দিন। আপনার শিশুকে বই দিন। আপনার গাছে পানি দিন। আপনার পরিবারকে সময় দিন।

আর, আপনার শিল্পীকে - টাকা দিন। এইটুকুই দরকার।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা