অনুরাগ কাশ্যপ: ছবি বানানোর অদ্ভুতুড়ে সব গল্প যার ঝুলিতে জমা!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
অনুরাগ কাশ্যপের সিনেমার গল্প নিয়ে দর্শকের গুণমুগ্ধ প্রশংসা এবং স্তুতিবাক্যের মোটেও শেষ নেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তুখোড় এই গল্পগুলোর অধিকাংশই তিনি লেখেন বিদেশে কিংবা বিমানে বসে। দীর্ঘ বিমানযাত্রায় যেহেতু করার কিছু থাকে না, চারপাশ থাকে অনেকটাই স্তব্ধ, এই সময়টাকেই তাই তিনি স্ক্রিপ্ট কিংবা আইডিয়া জেনারেট করার কাজে ব্যবহার করেন...
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি যুক্ত হিন্দি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সাথে। গড়পড়তা হিন্দি সিনেমার ধারকাছ দিয়েও হাঁটেন না তিনি। তার প্রতিটি নির্মাণই স্বকীয় সব বৈশিষ্ট্যে ঠাসা। শুধু যে আউট অফ দ্য বক্স সিনেমা নির্মাণ করেন তিনি, তাও না। অনেক অভিনেতাকে নিজ হাতে ধরে 'বলিউড' নামক আলো ঝলমলে মঞ্চে আনার কৃতিত্বও তার। এ প্রসঙ্গে সর্বাগ্রে বলা যেতে পারে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী কিংবা ভিকি কৌশলের নাম। এখানেই শেষ না। সিনেমার প্রতি তার ভালোবাসা, উন্মাদনা কিংবা পড়াশোনা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, সময়ের ব্যবধানে তিনি নিজেই রূপান্তরিত হয়েছেন বড়সড় এক ইন্ডাস্ট্রিতে। তিনি অনুরাগ কাশ্যপ। টানা দুই দশক ধরে দুর্দান্ত সব সিনেমার কারিগর এ মানুষটির সিনেমা বানানোর প্রক্রিয়ার যে অস্বাভাবিকতা, তার রকমফের শুনলে চোখ কপালে উঠবে যে কোনো স্বাভাবিক মানুষের। সেসব 'ছবি বানানোর গল্প' নিয়েই আজকের কথাবার্তা।
ক্রিয়েটিভ মানুষ মানেই অগোছালো হয়, এরকম এক বদ্ধমূল ধারণা আমাদের অনেকের মধ্যেই আছে। কথাটা যে সর্বৈব মিথ্যে, এমনও নয়। সত্যিই কিছু কিছু শিল্পী এমন আছেন, যারা গোছানো জিনিসপত্রের মধ্যিখানে কাজ করতে পারেন না। তাদের কাজ করার জন্যে বরাবরই এক অগোছালো পরিবেশের দরকার। অনুরাগ কাশ্যপ এই দলের বাসিন্দা। শুটিং স্পটের জিনিসপত্র টিপটপ দেখলেই তার নাভিশ্বাস ওঠে। কাজ করতে পারেন না। প্রসঙ্গত, বোম্বে ভেলভেট সিনেমার কথা আসবে সর্বাগ্রে। কাশ্যপ যখন 'বোম্বে ভেলভেট' এর শুটিং স্পটে প্রথমবার ঢুকলেন, সবকিছু গোছগাছ দেখে খানিকটা বিভ্রান্তই হয়ে গেলেন। পরবর্তীতে সবকিছু এলোমেলো করে এরপর তিনি শুরু করেছিলেন 'বোম্বে ভেলভেট' এর শুটিং। কাশ্যপের সিনেমার ক্ষেত্রে এরকম 'লণ্ডভণ্ড লঙ্কাকাণ্ড' এর ঘটনা আছে আরো অজস্র।
সিনেমা বানানোর পেছনের অস্বাভাবিক ঘটনার এখানেই শেষ না। সিনেমা নির্মাণের বহু আগে থেকেই অনুরাগ কাশ্যপ তার পছন্দের মিউজিক কম্পোজারদের বলে রাখেন সে সিনেমা নিয়ে কাজ শুরু করার জন্যে। তিনি মনে করেন, সিনেমার প্রোপার মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট এর জন্যে কম্পোজারদের যথেষ্ট সময় দেয়া অবশ্যই উচিত। প্রসঙ্গত, বলিউডের বিখ্যাত মিউজিশিয়ান অমিত ত্রিবেদীকে তিনি 'বোম্বে ভেলভেট' এর মিউজিক কম্পোজিশন করার জন্যে বলেছিলেন সে সিনেমা শুরুর পাঁচ বছর আগে। ভাবা যায়? এরকমটা হয়েছে 'গ্যাংস অব ওয়াসিপুর' এর ক্ষেত্রেও। স্নেহা খানওয়ালকার এই সিনেমার জন্যে মিউজিক কম্পোজিশন করেছেন টানা তিন বছর ধরে!
অনুরাগ কাশ্যপের সিনেমার গল্প নিয়ে দর্শকের গুণমুগ্ধ প্রশংসা এবং স্তুতিবাক্যের মোটেও শেষ নেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তুখোড় এই গল্পগুলোর অধিকাংশই তিনি লেখেন বিদেশে কিংবা বিমানে বসে। দীর্ঘ বিমানযাত্রায় যেহেতু করার কিছু থাকে না, চারপাশ থাকে অনেকটাই স্তব্ধ, এই সময়টাকেই তাই তিনি স্ক্রিপ্ট কিংবা আইডিয়া জেনারেট করার কাজে ব্যবহার করেন। দেশে এভাবে লেখার স্বাধীনতা পাওয়া যায় না, কারণ, 'আপনার সিনেমায় একটু সুযোগ চাই' বলা মানুষগুলো নিয়মিতই ঘুরঘুর করে তার চারপাশে। এই মানুষগুলোর কারণে ক্রিয়েটিভ জোন যেমন বাধাগ্রস্ত হয়, গল্পগুলোও ক্রমশ হারিয়ে যায়। ঠিক সে কারণেই লেখালেখির জন্যে কাশ্যপের পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকে বিমান কিংবা বিদেশ।
তবে বিমানে বসেই লেখা হোক কিংবা ঘরে বসে, নিজের লেখা স্ক্রিপ্টই যে শেষ কথা, এই মতবাদে বিশ্বাসী নন অনুরাগ কাশ্যপ। তিনি টিমওয়ার্কে বিশ্বাসী। তিনি একটি স্ক্রিপ্ট লেখার কিংবা একটি আইডিয়া পাওয়ার পর সে স্ক্রিপ্ট কিংবা আইডিয়াকে পৌঁছে দেন তার টিমের কাছে৷ কাশ্যপের টিম তখন নিজেদের মত করে স্বাধীনভাবে সেই স্ক্রিপ্ট কিংবা আইডিয়াকে মডিফাই করা শুরু করে। এবং মডিফিকেশন কিংবা ফিউশনের এই প্রসেসে অনুরাগ কাশ্যপ খুব একটা বাধাও দেন না। তিনি সবার ক্রিয়েটিভ লিবার্টিতে বিশ্বাসী। সেই লিবার্টিই বজায় থাকে সিনেমার শেষতক।
হিন্দি সিনেমায় এ জিনিসটা প্রায়ই দেখা যায়; ভারী মেকআপের ব্যবহার। ঠিক এ জিনিসটিই অপছন্দ অনুরাগ কাশ্যপের। সিনেমার গল্প বলার ক্ষেত্রে এই কটকটে মেকআপ যে খুব বিপজ্জনক এক বস্তু, সেটি তিনি বেশ ভালো করেই বোঝেন। এ কারণেই কাশ্যপের নির্মাণে চরিত্রগুলোর মেকআপ হয় খুবই মিনিমাল, ন্যাচারাল। স্বাভাবিক মুখাবয়বের জন্যে যতটুকু যা সাজসজ্জার প্রয়োজন, ততটুকুতেই বিশ্বাসী তিনি।
নির্মাণের নকশার স্থিরতার ক্ষেত্রে অনুরাগ কাশ্যপ খুবই আনপ্রেডিক্টেবল এক মানুষ। তার সিনেমায় হুটহাট চেঞ্জ হয়ে যায় সিনেমার মূল গল্প কিংবা ক্লাইম্যাক্স। নিজের মেজাজ-মর্জির উপর ভিত্তি করে বহুবার তিনি পাল্টেছেন সিনেমার গল্প। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে 'দেব ডি' সিনেমার কথা। এই সিনেমার সমাপ্তি খোলনলচে পালটে দিয়েছিলেন তিনি। এরকম অদ্ভুতুড়ে কাজ তিনি আরো বহু সিনেমাতে করেছেন। এবং সিনেমার শেষটা আনপ্রেডিক্টেবল রাখাকে তিনি ক্রমশই রূপান্তরিত করেছেন নিজের ফ্যাশনে৷ ট্রেডমার্কে।
শেষ করি, আরেকটি অদ্ভুতুড়ে তথ্য দিয়ে। কোনো একটি নির্মাণের জন্যে বাজেট দিলে অনুরাগ কাশ্যপ খেই হারিয়ে ফেলেন৷ তিনি এ প্রসঙ্গে বারবার অকপটে স্বীকার করেছেন-
যখন কোনো বাজেট থাকে না, তখনই আমি কাজ করতে পারি, বাজেট এলেই কেন যেন ওলটপালট হয়ে যায় সব। কাজ করা আর হয় না।
অনুরাগ কাশ্যপ ঠিক এই অদ্ভুত উন্মাদনায় ভর করেই নির্মাণ করেছেন এবং করছেন একের পর এক সিনেমা। কাশ্যপের ছবি বানানোর প্রক্রিয়া যতই পাগলাটে হোক, চূড়ান্ত ফলাফলে পর্দার সামনের গল্পে যে থাকে চমকে যাওয়ার বিস্তর উপকরণ... তা সর্বজনবিদিত। সিনেমা নিয়ে এই পাগলামো তার ভবিষ্যতেও থাকুক, এটাই প্রত্যাশা। নেপথ্যের গল্প যেরকমই হোক, পর্দার গল্প হবে খোলতাই...এটুকুই আমরা চাই কাশ্যপের নির্মাণে! নিয়মিত।
তথ্যসূত্র: ফিল্ম কম্পানিয়ন