নেটফ্লিক্সে রিলিজ পাওয়া বলিউডি সিনেমা লুডো নিয়ে হইচই শুরু হয়ে গেছে চারদিকে। পাঁচটা আলাদা গল্পের মিশেলে দুর্দান্ত এক সিনেমা বানিয়ে ফেলেছেন বাংলাভাষী পরিচালক অনুরাগ বসু, এর আগে যিনি বানিয়েছেন গ্যাংস্টার, লাইফ ইন এ মেট্রো, বরফি, জাজ্ঞা জাসুস- আরও একবার তিনিই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে লুডোর কারনে। সিনেমার প্লটের মতো তার জীবনটাও কিন্ত কম রোমাঞ্চকর নয়, চলুন, ঘুরে আসা যাক অনুরাগের জীবনের গল্পটা থেকে...

মানুষের জীবন অনেকটাই যেন অধিকাংশ বলিউডি ছবির চিত্রনাট্যের মতো, যেখানে একটি সুখের দৃশ্যের পরই চলে আসে একটি দুঃখের দৃশ্য। এবং এখন যে বলিউড পরিচালকের কথা বলব, তার জীবনের কাহিনীও ঠিক এরকমই কিছু ছিল। ছত্তিসগড়ের মত একটি ছোট্ট শহর থেকে উঠে এসে বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া কখনোই খুব সহজ কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু উপর্যুপরি তাকে আরও এমন অনেক পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে, যা অনেক বলিউডি ছবির কাহিনীকেও হার মানিয়ে দিতে পারে। 

অনুরাগ বসু বেড়ে ওঠেন ছত্তিসগড়ের ভিলাইয়ের এক বাঙালি পরিবারে। নিজেকে বেশ ভাগ্যবান মনে করেন তিনি, কারণ তার ছেলেবেলায় তাদের ছোট্ট শহরটি আরও অনেক দিক থেকে পশ্চাদপদ হলেও, সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ছিল খুবই সমৃদ্ধ। তবে তখনকার দিনেও, জীবনে উন্নতির সিঁড়ি বলতে সাধারণের চোখে বিবেচ্য ছিল কেবল একটি জিনিসই, আর তা হলো পড়ালেখা। তাই অনুরাগকেও বাস্তবতা মেনে নিয়ে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে হয়েছিল। তিনি পছন্দের বিষয় হিসেবে ইঞ্জিনিয়ারিংকে বেছে নেন এবং ভালো এক জায়গায় সুযোগও পেয়ে যান। 

পাশাপাশি তার সাংস্কৃতিক চর্চাও কিন্তু থেমে ছিল না। স্কুলজীবন থেকেই সাংস্কৃতিক নানা কাজের সাথে জড়িয়ে পড়েন তিনি। স্কুলে যখনই কোন অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা উঠত, সবার প্রথমে তারই ডাক পড়ত। এবং তখনই তিনি একটি জিনিস খুব ভালো করে অনুধাবন করেন, তা হলো- যে বিষয়টিতে তিনি সবচেয়ে বেশি দক্ষ তা হলো গল্প বলা। আর্টের যেকোন ফর্মেই তিনি খুব সুনিপুণভাবে অডিয়েন্সের সামনে একটি গল্প উপস্থাপন করতে সক্ষম। এবং যখন তিনি নিজের এই অসামান্য দক্ষতা সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হন, তখনই মনস্থির করেন যে পড়াশোনা আর করবেন না। ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছাও ততদিন তার মন থেকে উবে গেছে।

স্ট্যান্ডার্ড ১২ পাসের পরই তিনি বাবা-মাকে জানিয়ে দেন, ইঞ্জিনিয়ারিং তার কাজ নয়, তিনি যেতে চান ফিল্মের লাইনে, হতে চান একজন পরিচালক। বাবা-মাকে রাজি করাতে অবশ্য খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। যেহেতু তারা নিজেরাও ছিলেন সংস্কৃতিমনা ব্যক্তি, তাই তারা অনুরাগের স্বপ্নপূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াননি। কিন্তু তখনও, বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই)-কে তার কাছে মনে হয়েছিল অনেক দূরের কোন স্বপ্ন।

অনুরাগ বসু

১৯৯৬ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পরেই কেবল তার স্বপ্ন সত্যি হয়, তিনি পা রাখেন আলো ঝলমলে স্বপ্নের শহর বোম্বেতে। কিন্তু সেখানে পৌঁছেই তিনি উপলব্ধি করেন, জীবন এখানে খুবই কঠিন। তিনি চেয়েছিলেন একজন পরিচালক হতে, যে কিনা জাহাজের প্রধান নাবিক, কিন্তু তার তো এ ব্যাপারে পূর্বের কোন অভিজ্ঞতাই ছিল না। সেই সময়ে মরিয়া হয়ে তিনি অনেক লোকের কাছেই ধর্না দেন। এবং বেশিরভাগ জায়গা থেকেই প্রত্যাখ্যানের শিকার হন। এবং তখন তার কাছে মনে হতে থাকে, জীবনে বুঝি খুব বড় কোন ভুলই করে ফেলেছেন।

তারপরও তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এত সহজে হাল ছেড়ে দেবেন না। বরং তিনি নিজের জন্য একটি লক্ষ্য স্থির করলেনঃ দেড় বছর। এই দেড় বছরের মধ্যে কিছু একটা করতে পারলে তো ভালো, নাহলে ব্যাগ-বোঁচকা গুছিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাবেন! তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কোন বড় স্বপ্নই রাতারাতি সত্যি হয় না। তার আগে অনেক ছোট ছোট লক্ষ্য পূরণ করতে হয়। যেমন একজন পরিচালক হয়ত তিনি এখনই হতে পারবেন না, কিন্তু পরিচালকরা যেই সেটে কাজ করেন, সেখানে তো তার পক্ষে প্রবেশ সম্ভব।

কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব? একদমই নগণ্য কোন কাজের মাধ্যমে। সেরকমই একটি কাজ নিলেন তিনি, একজন ব্যাকগ্রাউন্ড ডান্সার হিসেবে! আর তারপর মেক-আপ আর্টিস্টের সহযোগী হিসেবে। শুধু এই কাজগুলোতেই তিনি নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখছিলেন না। বরং এসব কাজের মাধ্যমে অনেক নামজাঁদা ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসছিলেন তিনি, এবং যথাসাধ্য চেষ্টা করছিলেন তাদের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করার, যা পরবর্তীতে তার জন্য অনেক সহায়ক হবে। অনুরাগ আরও একদিন থেকে অনেক বেশি ভাগ্যবান ছিলেন যে যেই সময়টায় তিনি সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন একজন পরিচালক হওয়ার, ওই একই সময়টায় ভারতবর্ষজুড়ে স্যাটেলাইট চ্যানেলের একটি নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল। প্রচুর নতুন নতুন স্যাটেলাইট চ্যানেল চালু হচ্ছিল, ফলে সৃজনশীল ব্যক্তিদের জন্য ছিল অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগও। তখন তিনি 'তারা' নামে একটি নতুন চ্যানেলের নাম শুনতে পান, এবং মাত্র বোম্বেতে পা রাখার এক বছরের মাথায়ই, যখন তার বয়স মাত্র ২২, ওই 'তারা' চ্যানেলে তিনি একজন সহযোগী পরিচালকের কাজ পেয়ে যান। পরপর অনেকগুলো অনুষ্ঠানের পরিচালনা করেন তিনি, কিন্তু সেগুলো সবই টিভির জন্য।

এভাবে নিজেকে একপ্রকার প্রতিষ্ঠিত করে ফেললেও, তার মনের খিদে ঠিক মিটছিল না। কেননা তিনি পরিচালক হতে চেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তা তো টিভি অনুষ্ঠানের নয়। তিনি চেয়েছিলেন চলচ্চিত্রের পরিচালক হতে। তাই তিনি হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করেন চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশের একটি সুযোগ। ঠিক তখনই পরিচালক ও প্রযোজক মহেশ ভাটের কাছ থেকে একটি প্রস্তাব পান তিনি। সেটি ছিল 'মার্ডার' ছবিটি পরিচালনার প্রস্তাব। সেই ছবিটি দারুণ সাড়া ফেলে দেয় দর্শকমহলে, এবং বক্স অফিসেও প্রচুর আয় করে। সবমিলিয়ে চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে অনুরাগের শুরুটা একদম যেন স্বপ্নের মতোই হয়। তখন পর্যন্ত অনুরাগের কাছে মনে হচ্ছিল, তার জীবনটি যেন একদম নিখুঁত, সবকিছুই প্ল্যানমাফিক চলতে শুরু করেছে। তার ক্যারিয়ার সেই সময়টায় খুবই ঊর্ধ্বমুখী, আর তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন বিয়ে করার। তিনি বিয়ে করেন, এবং পরবর্তীতে তার স্ত্রী অন্তঃসত্তাও হন। সালটা তখন ২০০৪। তিনি তার পরবর্তী ছবির শুটিংয়ের কাজ করছিলেন। এবং ঠিক সেই সময়ই তার জীবনে আসে সবচেয়ে বড় ঝড়। তার শরীরে ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে! 

ক্যান্সারটি যেন দাবানলের মত তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল। তার বাঁচার সম্ভাবনা ছিল মাত্র ৫০ শতাংশ। ক্রমাগত তাকে একটি হাসপাতাল থেকে আরেকটি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হচ্ছিল। এবং অ্যাম্বুলেন্সে করে সেই যাত্রাগুলো ছিল খুবই ভয়াবহ। অনুরাগের বারবার মনে হতো, রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামের মধ্যেই বুঝি তার মৃত্যু হবে। মৃত্যুর আগে তার জীবনে শুধু একটিই চাওয়া ছিল, তা হলো অনাগত সন্তানের মুখ দেখে যাওয়া। আর সেজন্য তাকে আরও তিনটি মাস যেভাবেই হোক বেঁচে থাকতে হতো। 

তিন মাস বেঁচে থাকার মনসকামনা পূরণ হয়েছিল অনুরাগের। এবং যখন সেই তিন মাস পৃথিবীর বুকে বেঁচে থেকে সন্তানের মুখ দেখার অনাবিল প্রশান্তি তিনি পেয়েছিলেন, তখন তার মধ্যে এক নতুন উপলব্ধির জন্ম হয়েছিল যে জীবনে বড় বড় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হওয়ার চেয়ে ছোট ছোট পরিকল্পনা করে সেগুলোতে সাফল্য লাভ অনেক বেশি আনন্দের। তাই এবার তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এখন থেকে শুধু আগামী এক বছরের কথা চিন্তা করবেন। এবং সেই এক বছরের মধ্যেই নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন। 

সম্প্রতি নেটফ্লিক্সে মুক্তিপ্রাপ্ত 'লুডো' সিনেমার সেটে 

এবার তিনি ছোট ছোট পদক্ষেপ নিতে শুরু করলেন। তখনও তিনি শারীরিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি। বেশ কয়েকদিন তাকে ভেন্টিলেটরে কাটাতে হয়েছিল। তখন তার কাছে মনে হতো, স্রেফ বেঁচে থাকার মত আনন্দ আর কিছুতেই নেই। তাই যখন তিনি অবশেষে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেন, শারীরিকভাবে তখনও অনেকটাই ভঙ্গুর হওয়ার পরও তিনি কর্মজগতে ফিরে যেতে চাইলেন। কিন্তু অমন শারীরিক অবস্থায় কেউই তাকে নতুন ছবির কাজ দিতে চাইছিল না। তাই তিনি মনস্থির করেছিলেন, টিভিতে ফিরে যাবেন এবং সবকিছু নতুন করে শুরু করবেন। ঠিক তখনই তার হাতে আসে 'গ্যাংস্টার' ছবির প্রস্তাব। এবং পুরো ছবিটির কাজ তিনি করেন কেমোথেরাপি চলাকালীন অবস্থায়। 'গ্যাংস্টার'-এর সাফল্যের পর তিনি শুরু করেন 'লাইফ ইন এ মেট্রো' ছবির কাজ। এবং নিজের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে প্রশংসিত ও আলোচিত 'বারফি' ছবিটিও তিনি নির্মাণ করেন মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার পরই।

এখনও তিনি একের পর এক দর্শক ও সমালোচক মহলে নন্দিত ছবি নির্মাণ করে চলেছেন, যা তাকে পরিণত করেছে বর্তমান সময়ে বলিউডের অন্যতম সফল ও আলোচিত পরিচালকে। কিন্তু সাফল্য বা ব্যর্থতা এখন আর খুব বেশি ভাবায় না অনুরাগকে। মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। এক পর্যায়ে ধরেও নিয়েছিলেন আর বুঝি বেশিদিন বাঁচা হবে না। সেই অবস্থা থেকে বর্তমানে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন তিনি। তাই তিনি জানেন বেঁচে থাকা কী ভীষণ আনন্দের একটি ব্যাপার। সেই আনন্দকে সঙ্গী করেই তিনি কাজ করে যেতে চান। কখনও হয়ত সে কাজে সফল হবেন, আবার কখনও ব্যর্থ। কিন্তু তিনি জানেন, এরই নাম জীবন!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা