রেকর্ড গড়ে অস্কার জিতেও কেন চ্যাডউইক বোসম্যান 'ভক্তদের' তোপের মুখে অ্যান্থনি হপকিন্স?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

যারা তারকা, তাদের নিজেদের মধ্যে ভদ্রতা-শিষ্ঠাচার-সৌজন্যতা'র ঘাটতি হয়না কখনো। সমস্যা হয় এই ফ্যানাটিকদের নিয়ে। যারা পারে শুধু গায়ের জোরে হামবড়া ভাব দেখিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করতে...
ফ্লোরিয়ান জেলারের 'দ্য ফাদার' দেখতে দেখতেই ভাবছিলাম, সিনেমার মূল পাদপ্রদীপ, অর্থাৎ, অ্যান্থনি হপকিনস, যেরকম অসাধারণ অভিনয় করেছেন, এবার পুরস্কার বিতরণী মঞ্চগুলোতে বেশ একটা আলোড়ন তোলা তার জন্যে খুব একটা অসম্ভব কাজ হবেনা। সাম্প্রতিক অস্কারের ফলাফল সেই অনুমানকেই নির্ভুল প্রমাণিত করেছে। যদিও গত কিছুবছর ধরে 'অস্কার' নানারকম অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্তের মুখোমুখি দাড় করিয়েছে আমাদের। অ্যান্থনি'র বেলায় যে সেই 'কিংকর্তব্যবিমূঢ়' গাড্ডায় পড়তে হয়নি অডিয়েন্সকে, সেটাই বাঁচোয়া।
এ প্রসঙ্গে 'দ্য ফাদার' সিনেমার পরিচালকের একটা গল্প জানানোর লোভ সামলাতে পারছি না। ফ্লোরিয়ান জেলার যখন এই গল্পটি ভাবছিলেন, প্রথম থেকেই তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো 'দ্য হানিবল লেকটার'খ্যাত অ্যান্থনির নাম। পুরোপুরি তাকে ভেবেই গল্প লিখেছেন, স্ক্রিপ্ট সাজিয়েছেন তিনি।

গল্প লেখার কাজ শেষ করে ২০১৭ সালে এই সিনেমার স্ক্রিপ্ট পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি অ্যান্থনিকে, আর দুরুদুরু বক্ষে শুরু করেছিলেন দিন গোনা। কী হবে যদি অ্যান্থনি 'না' করে দেন? সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে জেলার নিয়ে ফেলেছিলেন কঠিন এক সিদ্ধান্তও। যদি অ্যান্থনি ফিরিয়ে দেয় তাকে, তাহলে হলিউডে এ সিনেমা তিনি বানাবেনই না আর। হয়তো পরে ফরাসীদেশে গিয়ে বানাবেন সিনেমা। এই গল্পে মনে পড়ে গেলো সত্যজিৎ রায়ের কথা। সন্তোষ দত্ত মারা যাওয়ার পরে 'জটায়ূ আর কেউ করতে পারবে না' বলে তিনি তুমুল জনপ্রিয় 'ফেলুদা সিরিজ' এর আর কোনো সিনেমা নির্মাণ করেননি। 'একলব্য' প্রতীজ্ঞায় জেলার যেন পাশ্চাত্যের 'সত্যজিৎ রায়'ই হয়ে গেলেন!
অ্যান্থনি'কে পাওয়ার জন্যে এতটাই মরিয়া ছিলেন জেলার, গল্পের সেই বৃদ্ধ লোকটির নামও রাখলেন অ্যান্থনি। এমনকি, জন্মের তারিখটাও পাল্টালেন না। বাস্তবের অ্যান্থনি আর গল্পের অ্যান্থনির জন্ম তারিখটাও তাই একই হয়ে রইলো। এত ঐকান্তিক ইচ্ছে নিয়ে ঈশ্বরকে ডাকলে, তিনিও বোধহয় সাড়া দিতেন। আর অ্যান্থনি হপকিন্স তো হাড়মাসের মানুষ। তিনি তাই স্ক্রিপ্ট ফেরালেন না। বাকিটা আমরা সবাই জানি।
অ্যান্থনি হপকিন্স' এর অভিনয় আমি মুগ্ধ হয়ে বরাবরই দেখে এসেছি। 'সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস সিরিজ', 'নিক্সন', 'দ্য ওয়ার্ল্ড'স ফাস্টেস্ট ইন্ডিয়ান', 'দ্য টু পোপস' থেকে 'দ্য ফাদার', এই বয়সে এসেও কী সাবলীল অভিনয়! 'ফর্ম ইজ টেম্পোরারি, ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট' যদি বাস্তব কারো উদাহরণ টেনে বলতে হয়, অ্যান্থনি সেখানে আসবেন প্রথম সারিতেই।

সেই অসাধারণ অভিনয়ের পুরস্কারই পেয়েছেন তিনি। অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড ছিনিয়ে নিয়েছেন 'বেস্ট অ্যাক্টর' ক্যাটাগরিতে। পুরস্কার পাওয়ার সাথে সাথে গড়েছেন রেকর্ডও। ৯৩ বছরের অস্কারের ইতিহাসে তিনিই সবচেয়ে প্রবীণ মানুষ, যিনি অর্জন করেছেন এই পুরস্কার। 'দ্য ফাদার' এর জন্যে যখন তিনি অস্কার পেলেন, তখন তিনি পেরিয়ে এসেছেন ৮৩টি বসন্ত! সে সাথে টপকে গিয়েছেন ক্রিস্টোফার প্লামার কেও। যিনি এতদিন ছিলেন 'সবচেয়ে বেশি বয়সী অস্কার বিজয়ী' নামক রেকর্ডের মালিক।
'অ্যান্থনি-ভক্ত'দের জন্যে খবরটা নিঃসন্দেহে তৃপ্তির। কিন্তু এ তৃপ্তি অখণ্ড হতে পারেনি৷ প্রয়াত 'চ্যাডউইক বোসম্যান' এর ফ্যানবেইজ আশা করেছিলো, 'ব্ল্যাক প্যান্থার' খ্যাত চ্যাডউইক জিতবেন এবারের অস্কার৷ তা আশা করাটা নিতান্ত আকাশকুসুম কল্পনাও ছিলোনা। 'মা রেইনি'স ব্ল্যাক বটম' সিনেমাতে চ্যাডউইক করেছেনও দুর্দান্ত অভিনয়। সে হিসেবে আশায় বুক বেঁধেছিলেন তাঁর ভক্তরাও। কিন্তু শেষপর্যন্ত পর্দার 'অ্যান্থনি'র কাছে হেরে গিয়েছেন পর্দার 'লেভি।'

এই ফলাফল ইতিবাচকভাবে নেওয়াটাই প্রাসঙ্গিক। যে যেই অভিনেতারই ভক্ত হোন না কেন, 'ন্যূনতম ভদ্রতা' মনুষ্যত্বেরই অংশ। অ্যান্থনি'র পুরস্কার প্রাপ্তিতে যেভাবে এই ফ্যানবেইজ চড়াও হয়েছে, সেটা খুবই দৃষ্টিকটু। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, অ্যান্থনি পুরস্কার ঘোষণার মূল অনুষ্ঠানে আসেন নি কেন? অথচ, ৮৩ বছর বয়স্ক মানুষটি তখন ছিলেন নিজের বাড়িতে। বাবার সমাধিস্থলের পাশে নিজের গ্রামের বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আবার অ্যান্থনি'কে নিয়ে নানারকম মিমও ছড়িয়ে পড়েছে ভার্চুয়াল দুনিয়ায়। কেউ ট্রল করছেন, কেউ তাকে নীচে নামিয়ে চ্যাডউইক'কে ওপরে ওঠাতে চাচ্ছেন৷ হলফ করে বলা যায়, চ্যাডউইক বেঁচে থাকলে তার ভক্তদের এ বাড়াবাড়ি দেখলে, লজ্জায় মুখ লুকোনোরও জায়গা খুঁজে পেতেন না৷
অথচ যাকে নিয়ে 'ব্ল্যাক প্যান্থার' ভক্তদের এত অস্বস্তি-বিদ্রুপ-রেষারেষি, সেই মানুষটি 'অস্কার'বিজয়ের খবর শুনে খুশি হওয়ার পাশাপাশি উচ্চারণ করেছেন আরেকজন মানুষের নামও। হ্যাঁ, চ্যাডউইক বোজম্যানের নামই বলেছেন তিনি। শ্রদ্ধা জানিয়েছেন প্রয়াত এই অভিনেতার প্রতি।
হয়তো এটাই পার্থক্য। যারা তারকা, তাদের নিজেদের মধ্যে ভদ্রতা-শিষ্ঠাচার-সৌজন্যতা'র ঘাটতি হয়না কখনো। তারা তাদের মতই সবকিছু মানিয়ে চলেন। সমস্যা হয় এই ফ্যানাটিকদের নিয়ে। যারা পারে শুধু একটি কাজই করতে, গায়ের জোরে হামবড়া ভাব দেখিয়ে ধরাকে সরাজ্ঞান করতে। এদের জন্যে সমবেদনা জানানো ছাড়া আর কিছুই বলার নেই।
ঈশ্বর এদের মস্তিষ্কে ছটাকখানেক বুদ্ধি দিক, বিবেক দিক।