এখন যদি 'আনন্দ'র রিমেক হয়, সেখানে রাজেশ খান্নার 'বাবুমশাই, জিন্দেগি বড়ি হোনি চাহিয়ে, লম্বি নেহি' বলে সে ভুবনমোহিনী হাসি থাকবে না, অমিতাভ বচ্চনের গলায় গুলজারের বিখ্যাত কবিতা 'মওত, তু এক কবিতা হ্যায়' থাকবে না, রমেশ রাওদের হৃদয় নিংড়ানো অভিনয় থাকবে না, মান্না দে'র জাদুকরী গান 'জিন্দেগি ক্যায়সি হ্যায় পেহলি' থাকবে না। আর এসবই যদি না থাকে, তাহলে এই রিমেক সিনেমা মানুষ কেনই বা দেখবে?

কালজয়ী সিনেমা আসলে কি, এর উত্তর একেকজনের কাছে একেকরকম হলেও, আমার কাছে উত্তরটা খুব সোজা। যে সিনেমা বহুবছর পরে এসেও প্রথমবারের মতই আলোড়িত করে, মুখোমুখি করে যুযুধান সব অনুভুতির, মূলত সে সিনেমাকেই স্থান দিই 'কালজয়ী সিনেমা'র তালিকায়। যে হিসেবে- ১৯৭১ সালে মুক্তি পাওয়া হৃষিকেশ মুখার্জি'র সিনেমা 'আনন্দ'কে 'কালজয়ী সিনেমা' হিসেবে স্বীকৃতি দিতে দুইবার ভাবতে হয়না। এ সিনেমা অনায়াসেই ঢুকে পড়ে ভেতরের এমন এক প্রকোষ্ঠে, যে প্রকোষ্ঠে জায়গা হয় শুধুমাত্র বিশেষ কিছু নির্মাণের। এছাড়াও 'আনন্দ' চরিত্রে রাজেশ খান্না এখানে এমনই অভিনয় করেন, ক্যামেরা ভেদ করে এমনভাবে ঢুকে পড়েন করোটির নির্দিষ্ট খাপে, এ চরিত্র এমনই অতলে নিয়ে ভাবায়, ভ্রম হয়- সিনেমা মানে আসলেই কি সাজানো মিথ্যের বেসাতি? নাকি, সিনেমা গূঢ়-অর্থে জীবনকেই খানিকটা উল্টেপাল্টে দেখা?

রাজেশ খান্নার অভিনয়ে মুগ্ধ হতে হয় বিলকুল

এটা তো স্বাভাবিক, ২০২২ এর এ সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রযুক্তি পাল্টেছে, পাল্টেছে আমাদের ভাবার-দেখার-বলার মানসিকতা। পাশাপাশি, পাল্টেছে গল্প বলার ধরণ কিংবা সমীকরণও। এবং, ঠিক সে পরিবর্তন বিবেচনাতেই ধরে নিয়েছিলাম, পঞ্চাশ বছর আগের এক সিনেমা দেখে মন খারাপ হবে, বা, খানিকটা থমকে যাবো, বা, গল্পের আকর্ষণে বুঁদ হবো বিস্তর... সেটা হয়তো হবেনা। কিন্তু সেই অসম্ভব বিষয়টিকেই শেষমেশ যেভাবে সম্ভব করে 'আনন্দ', বিস্মিত হওয়া ছাড়া উপায়ও থাকে না। এটা জেনেও অবাক হই- 'আনন্দ' চরিত্রে 'রাজেশ খান্না' প্রাথমিক বাছাই ছিলেন না, কিন্তু সেই 'রাজেশ খান্না'ই শেষপর্যন্ত এসে এমন অভিনয় করেন এখানে, মুগ্ধতার সব সীমাই যেন ধরে ধরে অতিক্রম করে যান তিনি। ক্যান্সারে আক্রান্ত এক মানুষ, যিনি বাঁচবেন আর বড়জোর মাস-ছয়েক, এরকম এক দোদুল্যমান চরিত্রে জীবনকে যেভাবে নিবিড় এবং প্রগাঢ়ভাবে কাছে টেনে নেন তিনি, মায়ায় জড়ান কাছে-দূরের সবাইকে, এবং তা দেখে মন নানারকম ভাবনাতে যেভাবে দ্রবীভূত হয়, সেখানটায় এসেই বুঝতে পারি- অভিনয় বোধহয় একেই বলে! 

আনন্দ সায়গাল- ডঃ ব্যানার্জী'র জুটিটাকেও বা এড়াই কিভাবে? রাজেশ খান্না ও অমিতাভ বচ্চন; দুই মহীরূহ যেভাবে সরল সম্পর্কের এক আবরনে জড়ান নিজেদের, হাসি-বিষাদে যেভাবে হন মুখোমুখি, হন পরস্পরের অবলম্বন, তা অবাক করে। এছাড়াও, এ সিনেমায় যারা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র চরিত্রে অভিনয় করেন- সুমিতা স্যানাল, রমেশ দেও, ললিতা পাওয়ার... কারো অভিনয়ই ফেলে দেয়ার মত হয়না। সব চরিত্রই লতায়-পাতায় যেহেতু জড়িয়ে থাকে 'আনন্দ' নামের মৃত্যু-পথগামী যুবকের সাথে, তাই, এই যুবকের সাথে এই মানুষদের রসায়ন কেমন হয়, সেটাই নিয়ামক হয় সিনেমার ভবিষ্যতের। এবং, সেখানে এসেই শতভাগ প্রাসঙ্গিক হয়ে যায় চরিত্রগুলো। 

অমিতাভ- রাজেশের জুটিও মুগ্ধ করে বিস্তর

'আনন্দ'র শুরুর গল্পটাও বেশ অন্যরকম। নির্মাতা হৃষিকেশ মুখার্জি আর সুপারস্টার রাজ কাপুর ছিলেন ভালো বন্ধু। এই দুই বন্ধু নিয়মিত আড্ডায়ও বসতেন। যে আড্ডারই নানা প্রসঙ্গের মধ্যে একবার এলো মৃত্যুর প্রসঙ্গ। এবং যে প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে বলতেই হৃষিকেশ মুখার্জি পেয়ে গেলেন 'আনন্দ'র আইডিয়া। এবং শেষমেশ সিনেমা বানালেনও। যে সিনেমা হলো কাল্ট ক্ল্যাসিকও। যে সিনেমার নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয় এখনও। এবং, আক্ষেপ ও আতঙ্কের বিষয় এটাই, যে সিনেমারই রিমেক করতে যাচ্ছে বলিউড! 

বলিউড এখন কোনোকিছুর রিমেক করতে চাইলে সিনেমাপ্রেমীদের মধ্যে একটা 'ত্রাহি ত্রাহি রব' ছড়িয়ে পড়ে। যেটা স্বাভাবিকও।  মূল সিনেমার গল্পকে কেটেকুটে ঘোঁট পাকিয়ে শেষপর্যন্ত তারা যা তৈরী করে, সেটাকে আর যাই হোক, সিনেমা বলে স্বীকৃতি দেয়ার যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না!  তাছাড়া, অন্য সিনেমাকে নিয়ে রিমেক করা মেনে নেয়া গেলেও, যে 'আনন্দ' এখনও দর্শকের মুখে মুখে ফেরে, যে সিনেমা দেখে এখনও মানুষ ঠিক প্রথমবারের মতই আলোড়িত হয়, সে সিনেমাকে রিমেক করার আবশ্যকতা কোথায়, প্রশ্ন ওঠে সেখানেও।

যেখানে 'আনন্দ' এখনও প্রাসঙ্গিক, সব জেনারেশনের মানুষই যেখানে এ সিনেমাকে নিয়ে কমবেশি ওয়াকিবহাল, যে সিনেমার তাৎপর্য-গুরুত্ব কিংবা মাধুর্য যেখানে কমেনি একবিন্দুও, সে সিনেমাকে নিয়ে অহেতুক টানাহেঁচড়ার আসলেই কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, চাপান-উতোরের সুযোগ থাকে সেখানেও। যদিও প্রযোজকদের দাবী, এ সিনেমার কথা অনেকেই ভুলে গিয়েছেন, তাই সবাই যাতে নতুন করে আবার এ সিনেমাকে উপলব্ধি করতে পারে, এজন্যে রিমেক করছেন তারা। কিন্তু কেউই যে 'আনন্দ'কে ভোলেনি, তার প্রমাণের জন্যে বেশিদূর যেতে হবেনা, সোশ্যাল মিডিয়াতে এই সিনেমার রিমেকের প্রতিবাদে মানুষজনের সরব হওয়া দেখলেই বুঝতে পারার কথা তা। সেটুকু বিবেচনায়, রিমেকের এই উদ্যোগ কি আসলেই 'আনন্দ'কে রিভাইভ করার সৎচিন্তা, নাকি, এই কাল্ট ক্ল্যাসিকের ব্রাণ্ডনেম ভাঙ্গিয়ে কিছু টাকা কামাইয়ের পায়তারা, বিশাল এক প্রশ্ন প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে ঝুলে থাকে সেখানেও। 

'আনন্দ'র ব্রাণ্ডনেমকে ভাঙ্গিয়ে অর্থের সংস্থান করাই কি এ রিমেকের উদ্দেশ্য?

হয়তো সাধারণ দর্শকদের এত প্রতিরোধ, প্রতিবাদের পরেও, প্রযোজকেরা শেষপর্যন্ত 'আনন্দ'র রিমেক ভার্সন বানাবেন। সেখানে হয়তো টপ-রেটেড অভিনয়শিল্পীদেরও নেবেন। প্রযুক্তি কিংবা অর্থের ব্যাপক আধিপত্যও থাকবে হয়তো সেখানে। কিন্তু সে সিনেমায় রাজেশ খান্নার 'বাবুমশাই, জিন্দেগি বড়ি হোনি চাহিয়ে, লম্বি নেহি' বলে সে ভুবনমোহিনী হাসি থাকবেনা, অমিতাভ বচ্চনের গলায় গুলজারের বিখ্যাত কবিতা 'মত, তু এক কবিতা হ্যায়' থাকবেনা, রমেশ রাওদের হৃদয়-নিঙ্গড়ানো অভিনয় থাকবে না, মান্না দে'র জাদুকরী গান 'জিন্দেগি ক্যায়সি হ্যায় পেহলি' থাকবে না... এই শূন্যস্থানগুলো কিভাবে পূরণ হবে? এসব বাদ দিলে 'আনন্দ'র আর থাকবেও বা কি? এসব না থাকলে, এই রিমেকের তাহলে অর্থও বা কি?


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা