অর্কেস্ট্রার আয়োজন আর ভিজ্যুয়াল প্রেজেন্টেশন- দুই জায়গাতেই সাড়ে তিন মিনিটে একটুকরো বাংলাদেশ উঠে এসেছে খুব চমৎকারভাবে। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকা জাতীয় সঙ্গীতের অর্কেস্ট্রা ভার্সনের মন্ত্রমুগ্ধতার সঙ্গে বাংলার প্রাণ-প্রকৃতি দেখতে দেখতে অজান্তেই গলা ভারী হয়, চোখে জল আসে। সেই আবেগে বাঁধ দেয়ার সামর্থ্য তো নেই...

তখন স্কুলে পড়ি। ক্লাস শুরুর আগে বাধ্যতামূলক এসেম্বলি, মিনিট দশেক রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা। গা বাঁচানোর অনেক ফন্দি-ফিকির, কে চায় কড়া রোদে মাঠে দাঁড়িয়ে পিটি নাম্বার ওয়ান-টু-থ্রি-ফোর কিংবা আরামে দাঁড়ানো আর সাবধান হবার ঝামেলায় জড়াতে? 

তবু ওই যন্ত্রণার মাঝে অন্যরকম একটা ভালো লাগার ব্যাপার ছিল জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার অংশটুকু। মিনিট দুয়েক সময় নিয়ে জাতীয় সঙ্গীতের পুরোটা গাওয়া হতো, চার লাইন নয়। চারপাশে তখন পিন ড্রপ সাইলেন্স, সময় যেন থমকে দাঁড়াতো কয়েক মুহূর্তের জন্য। তিন-চারশো ছেলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে 'মা তোর বদনখানি মলিন হলে' গাওয়ার সময় গলা ভারী হয়ে আসতো অজান্তেই। 

ডানপিটে ছেলেটা, স্কুল ছুটির পর যে টেনিস বল দিয়ে ফুটবল খেলে, টিচারের চোখ ফাঁকি দিয়ে পাঠ্যবইয়ের নিচে তিন গোয়েন্দা রেখে পড়ে, টিফিনে বাড়তি একটা সিঙাড়ার জন্য যে ধাক্কাধাক্কি করে শার্ট ছেঁড়ে, ক্রিকেট ম্যাচ হারার শোধ তুলতে ব্ল্যাকবোর্ডে সহপাঠীর নাম লিখে যে মার খাওয়ায়- সেই ছেলেটার ঠোঁট কেঁপে ওঠে 'আমার সোনার বাংলা' গাওয়ার সময়। দেশপ্রেম, দেশাত্ববোধ- এসব ভারী ভারী শব্দের মানে বোঝার বয়স হয়নি তখনও। জাতীয় সঙ্গীতের গুরুত্বও জানা নেই৷ শুধু মনে হতো, এই গানটা খুব স্পেশাল। হৃদয়ের খুব কাছের।

ইউটিউবে সার্চ দিলে বিভিন্ন দেশের জাতীয় সঙ্গীতের নানা রকমের ভার্সন পাবেন আপনি। ফ্লুট (বাঁশি) ভার্সন, গিটার ভার্সন, হারমোনিয়াম ভার্সন। আরেকটা জনপ্রিয় ধরন হচ্ছে অর্কেস্ট্রা ভার্সন। ইউরোপিয়ান ক্ল্যাসিক অর্কেস্ট্রা স্টাইলের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের জাতীয় সঙ্গীতের ফিউশন- এটা খুব কমন একটা প্র‍্যাকটিস। আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারত- সবার আছে। আমাদের এতদিন ছিল না৷ জাতীয় সঙ্গীত যেহেতু সেন্সেটিভ একটা ইস্যু, পান থেকে চুন খসলে অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হবার সমূহ সম্ভাবনা- তাই এসব এক্সপেরিমেন্ট বাংলাদেশে কেউ করেনি এদ্দিন। 

ভিজ্যুয়াল প্রেজেন্টেশনে মুগ্ধ করেছে এই আয়োজন

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করছে বাংলাদেশ। সেই উপলক্ষ্যে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের একটা অর্কেস্ট্রা ভার্সন বানানো হয়েছে। তিন মিনিট পঁচিশ সেকেন্ডের ভিডিও; সাড়ে তিন মিনিটের মুগ্ধতার এক প্যাকেজ যেন! দেখতে গিয়ে মনে হলো, দুম করে বয়সটা বারো-চৌদ্দ বছর কমে গেছে। সাদা স্কুল ইউনিফর্ম পরে মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি, সামনে পতপত করে উড়ছে লাল সবুজ পতাকাটা। অর্কেস্ট্রা ভার্সনের দারুণ সঙ্গীতায়োজন কানে মায়াবী পরশ ছড়ালো, ভিজ্যুয়াল প্রেজেন্টেশনটা চোখের সামনে তৈরি করলো মন্ত্রমুগ্ধ আবেশ। 

জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে এমন দারুণ এক্সপেরিমেন্ট বাংলাদেশে কখনও হয়নি। কেউ হয়তো ভাবেনি, ভাবলেও সাহস করেনি। সুস্মিতা আনিস নামের এক ভদ্রমহিলা করলেন। তিনি নিজেও গানের মানুষ, নজরুল সঙ্গীতের শিল্পী হিসেবে পরিচিতি আছে। জাতীয় সঙ্গীতের অর্কেস্ট্রা ভার্সনের ভিডিওটা আপলোড দেয়া হয়েছে তার চ্যানেলে। ইউরোপিয়ান অর্কেস্ট্রা ফ্লেভারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা, গগন হরকরার সুর করা গানের মেলবন্ধন হলো সেখানে, পশ্চিমের সুরের আভিজাত্যের সঙ্গে মিশে গেল প্রাচ্যের নান্দনিকতা। 

সুস্মিতা আনিস- গোটা আয়োজনের নেপথ্যে ছিলেন তিনি

প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সুস্মিতা আনিস এবং তার টিম মেম্বাররা ইউরোপিয়ান অর্কেস্ট্রা টিমের সঙ্গে মিলে জাতীয় সঙ্গীতের অর্কেস্ট্রা ভার্সনের কাজ একটু একটু করে এগিয়ে নিয়েছেন৷ রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার কাছ থেকে তারা জাতীয় সঙ্গীতের অরিজিনাল নোটেশনটা সংগ্রহ করেছেন, যাতে বিশাল এই আয়োজনে বিন্দুমাত্র খুঁত না থাকে কোথাও। সঙ্গীতায়োজনের তত্বাবধানে ছিলেন কলকাতার অমিত-ইশান জুটি। অর্কেস্ট্রা তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে ছিলেন বৃটিশ অর্কেস্ট্রা আর্টিস্ট অ্যান্ড্রু টি ম্যাকে। 

জাতীয় সঙ্গীতের এই অর্কেস্ট্রা ভার্সন যতটা অসাধারণ, তার ভিজ্যুয়াল ট্রিটমেন্টও ততটাই দুর্দান্ত। ক্যামেরা নিয়ে পরিচালক আগা নাহিয়ান আহমেদ এবং সিনেমাটোগ্রাফার শাহাদাত সেতু ছুটে গেছেন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। চৌষট্টি জেলা, ছয়টি ঋতু, শহর, গ্রাম, পাহাড়, সাগর- সবকিছু নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তারা। নবান্ন থেকে গ্রাম্য মেলা, মাছ ধরা থেকে পিঠাপুলির উৎসব, শীতের কুয়াশা থেকে বর্ষার ভেজা প্রকৃতি- সাড়ে তিন মিনিটে একটুকরো বাংলাদেশ উঠে এসেছে খুব চমৎকারভাবে। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকা জাতীয় সঙ্গীতের অর্কেস্ট্রা ভার্সনের মন্ত্রমুগ্ধতার সঙ্গে বাংলার প্রাণ-প্রকৃতি দেখতে দেখতে অজান্তেই গলা ভারী হয়, চোখে জল আসে। সেই আবেগে বাঁধ দেয়ার সামর্থ্য তো নেই... 

জাতীয় সঙ্গীতের অর্কেস্ট্রা ভার্সনটি উপভোগ করুন এখানে ক্লিক করে- 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা