নির্মাণের পর সেন্সর বোর্ড নানা অজুহাতে সিনেমাটিকে সেন্সর ছাড়পত্র দিতে চাইছিল না। সিনেমায় ব্যবহৃত ‘জয় বাংলা, পাকিস্তানি মিলিটারি, রাজাকার ইত্যাদি শব্দ বা পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক অত্যাচারের দৃশ্য নিয়ে আপত্তি ছিল সেই সময়ের সেন্সর বোর্ডের সদস্যদের, কারন তৎকালীন স্বৈরশাসক আমলে এইসব কিছু সিনেমা বা নাটকে দেখানো নিষিদ্ধ ছিল...

ছোটবেলার এক ফুপাতো ভাইয়ের সাথে ‘গুলিস্তান’ হলে প্রথমবার সিনেমা দেখার মাধ্যমে চলচ্চিত্র এবং এর তাৎপর্য নিয়ে যে ভালো লাগা এবং ভালোবাসা তৈরী হয়েছিল, সেই ভালোবাসা এবং দেশপ্রেম থেকেই আজো চলচ্চিত্র মাধ্যমে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন তিনি। শৈশব পেরিয়ে কৈশোর বা তারুন্যের সময়ে দেশ-বিদেশের ভালো সিনেমা দেখার ইচ্ছা থেকে ফিল্ম সোসাইটির সদস্য হিসেবে পথচলা শুরু হয়েছিল তার। আর এই পথচলাই আমাদের বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে এক কিংবদন্তি নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে তাকে। বলা হচ্ছে খ্যাতনামা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মোরশেদুল ইসলামের কথা। যার প্রতিটি নির্মান মুগ্ধতা ছড়িয়েছে এবং নান্দনিক ভাবে দেশ, জাতি এবং সমাজের নানা সময়কে সেলুলয়েডে বন্দী করেছে।

নির্মাতা হিসেবে মোরশেদুল ইসলামের প্রথম নিবেদন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আগামী’র মাধ্যমে। মোরশেদুল ইসলাম যখন ছাত্রাবস্থায় তার প্রথম সিনেমা ‘আগামী’ বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন তখন তাঁর মনে হয়েছিলো যে, সেই সময়টায় স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নানাভাবে ভুলিয়ে দেয়ার একটা ষড়যন্ত্র চলছে এবং আরেকটি ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি শুধু পুনর্বাসিতই হচ্ছে না বরং এরাই ক্ষমতার কেন্দ্রে বিচরণ করছে। নিজ চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এমন অবক্ষয় একজন দেশপ্রেমী মোরশেদুল ইসলামকে জর্জরিত করছিলো সেজন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধকেই তার প্রথম সিনেমাটির প্রেক্ষাপট হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।

১৯৮২ সালে দাঁড়িয়ে ‘আগামী’ সিনেমার গল্প ও চিত্রনাট্য মোরশেদুল ইসলাম নিজের লিখেছিলেন। ‘আগামী’র মাধ্যমে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন, দেশ স্বাধীন হলো যাদের মাধ্যমে সেই মুক্তিযোদ্ধারা দেশে ঘটা নানা অনিয়মের প্রতিবাদ করতে পারছে না কিন্তু একটি বাচ্চা ছেলে যার জন্ম ১৯৭১ সালে সে তার নিজের মতো প্রতিবাদ করছে। অন্যভাবে বলা যায় এই ছেলেটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করছে (যদিও সিনেমায় এটা প্রতীকী অর্থে তুলে ধরা হয়েছিলো)এবং এই বাচ্চা ছেলেরাই হচ্ছে ‘আগামী’৷ আগামীতে এরাই হয়তো ত্যাগ, কষ্ট আর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতার চেতনাকে ফিরিয়ে আনবে।

সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এমন একটা গল্পকে সেলুলয়েডে তুলে ধরা কম ঝক্কির ছিল না। গল্পটি লেখার সময় বেশ কিছু ইস্যু এবং ব্যাপারের দিকে তাঁকে খেয়াল রাখতে হয়েছে। প্রথমত গল্পটা কিছুটা প্রতীকী ভাবে দেখালেও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অভিজ্ঞতা থেকে নানা সংলাপ, চরিত্র এবং ১৯৮২ সালে দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত অবস্থান বিশ্বাসযোগ্য ভাবে তুলে ধরা ছিলো চ্যালেঞ্জিং। এরপরের চিন্তা ছিলো সিনেমাটি বানানো হবে অত্যন্ত কম বাজেটের সুতরাং খুব বেশী রাতের দৃশ্য দেখানো যাবে না। কারণ রাতের দৃশ্য মানেই লাইট এবং খরচ। অনেক দেনা, পরিশ্রম এবং অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তিন মাসের মধ্যে সিনেমার কাজ শেষ করেন তিনি।

মোরশেদুল ইসলাম

সেলুলয়েড উঠে এসেছিলো যে, আশির দশকে স্বাধীনতা যুদ্ধ তো শেষ,কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা এখন এই স্বাধীন দেশে অবহেলিত! রাজাকাররা এখন গ্রামের মাতব্বর বা চেয়ারম্যান যারা ক্ষমতার অধিকারী। অন্যদিকে এক বীরঙ্গনার গ্রামের মাতব্বরের কামনার বশবর্তী হতে রাজী না হওয়ায় গ্রামচ্যুত হওয়া। এমনই এক সাহসী গল্প নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নিয়ে হাজির হলেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মোরশেদুল ইসলাম।

নির্মাণের পর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড নানা আপত্তির কথা বলে সিনেমাটিকে সেন্সর ছাড়পত্র দিতে দেরি করতে থাকে। সিনেমাতে ব্যবহৃত ‘জয় বাংলা, পাকিস্তানি মিলিটারি, রাজাকার ইত্যাদি শব্দ বা পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক অত্যাচারের দৃশ্য নিয়ে আপত্তি ছিল সেই সময়ের সেন্সর বোর্ডের সদস্যদের,কারন তৎকালীন স্বৈরশাসক আমলে এইসব কিছু সিনেমা বা নাটকে দেখানো নিষিদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে এইসব ইস্যু নিয়ে সারাদেশে প্রতিবাদ হলে শেষ পর্যন্ত সেন্সর বোর্ড ছাড়পত্র দিতে বাধ্য হয়েছিলো।

১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে চট্টগ্রামে সিনেমাটি প্রথম প্রিমিয়ার শো অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণ দর্শকদের কাছ থেকে পাওয়া প্রশংসা মোরশেদুল ইসলামকে সাহস যোগায়। সিনেমাটি প্রথমবার বাণিজ্যিকভাবে প্রদর্শিত হয় ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখে ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিলে। সেখানে দর্শকদের ভিড় এতটাই ছিল যে একপর্যায়ে ব্রিটিশ কাউন্সিলের দরজা ভেঙে যায়, তাতে মোরশেদুল ইসলাম নিজেও আহত হন। এরপর পাবলিক লাইব্রেরিতে বড় পরিসরে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয় ‘আগামী’র। একটা শো বাড়িয়ে দিয়েও দর্শকদের ভিড় কমানো যাচ্ছিল না, বরং টিকেট কেনার লাইন রাস্তায় নেমে গিয়েছিল। এককথায় বলতে গেলে পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, আলী যাকের, ফাহমিদা পারভীন মিঠু, রওশন জামিল অভিনীত ‘আগামী’ দর্শকের মন জয় করতে সমর্থ হয়েছিলো পুরোপুরিভাবে।

দেশের এই ভিন্নধারার চলচ্চিত্রে সাফল্য বা প্রশংসা প্রাপ্তির পর ১৯৮৫ সালে নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত ১০ম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্‍সবে চলচ্চিত্রটি প্রদর্শিত হয় এবং মোরশেদুল ইসলাম শ্রেষ্ঠ পরিচালনার জন্য রৌপ্য ময়ূর অর্জন করেন। এছাড়া ৯ম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সিনেমাটি শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে পুরস্কৃত হয়। ১৯৮৫ সালে জুন মাসে ইতালীতে একটি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও অংশগ্রহণ করে ‘আগামী’।

বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের শর্টফিল্ম ফোরামের অগ্রযাত্রার শুভসূচনা হয়েছিল এই সিনেমা দিয়ে। বানিজ্যিক ধারার পাশাপাশি এই ভিন্ন ধারার সিনেমা নিয়েও তখন থেকে কাজ শুরু হতে থাকে পুরোদমে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখানো বা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন ধারার সূচনা এসব কিছুর এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে আছে মোরশেদুল ইসলামের ‘আগামী’। দেশীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘চরকি’তে এই ইতিহাসের সেই সময় ধরে রাখা এই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি দেখা যাবে। যারা দেখেননি বা দেখার সুযোগ হয়ে উঠেনি তারা একেবারে ফ্রিতে দেখে নিতে পারেন এই নান্দনিক কাজটি।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা